ছবি: সংগৃহীত
গত কয়েক মাসে সকলের জীবনই বদলে গিয়েছে। অনেকেরই বেশির ভাগ সময় কাটছে বাড়িতে। অফিস, সংসারের কাজ বেড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা নিজের পরিবারের মাঝে থাকাও তো কম কথা নয়। যে ছেলেটা বা মেয়েটা দিনে তিন-চার ঘণ্টা মা-বাবাকে কাছে পেত, সে এখন দরকারে-অদরকারে দু’জনকেই কাছে পাচ্ছে। খিদে পেলেই ‘মা খেতে দাও’ বা স্নানের সময়ে ‘বাবার কাছে স্নান করব’... এই আবদারও তার মানা হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবী সুস্থ হলেই রাস্তায় বেরোতে হবে সকলকে। আবার অফিসশেষে সেই দু’তিন ঘণ্টাই বরাদ্দ থাকবে একরত্তির জন্য। তখন কিন্তু ওরই কষ্ট হবে। মা-বাবাকে খুঁজবে সারাটা দিন। আবার যাদের সন্তান টিনএজের দোরগোড়ায় বা সবে পৌঁছেছে, তাদের অন্য সমস্যা। সন্তান বড় হলে তাদের নিজস্ব স্পেস দরকার। সেই স্পেসটুকু তারা পাচ্ছে না। বাচ্চার জন্য মা-বাবাকেই কিন্তু আগে অভ্যেস বদলাতে হবে।
সন্তানের বয়স কম হলে
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘অনেকের মা-বাবা দু’জনেই ওয়র্কিং। আগে হয়তো সন্তান বেশির ভাগ সময় কাটাত কেয়ারগিভার বা দাদু-ঠাকুমার কাছে। মা-বাবার কাছে কিছু চাওয়ার হলে বা বলার হলে তাদের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত শিশুটিকে। কিন্তু এখন আর তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। চাইলেই কাছে পেয়ে যাচ্ছে মা-বাবাকে। সমস্যার শুরু এই পেয়ে যাওয়ার পরিতৃপ্তি থেকে। তার উপরে সে কিছুটা সময় নিজের মতো খেলা করত। হয়তো বিল্ডিং ব্লক বানাচ্ছে বা পাজ়ল সল্ভ করছে। একাই করত। কিন্তু এখন তারা ধরেই নিচ্ছে যে মা-বাবা বাড়িতে আছে বলে তাদের সঙ্গে সময় কাটাবে।’’
তারা একা থাকতে থাকতে কিছু কাজ নিজেরাও করতে শিখছিল, স্বনির্ভর হয়ে উঠছিল হয়তো। কিন্তু মা-বাবার সাহায্য পেয়ে আবার সে ফিরে যাচ্ছে আগের পর্যায়ে। যা যা একা করতে শিখেছিল, সেগুলি ভুলে যাচ্ছে বা তার জন্য মা-বাবার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
আবার ইমোশনাল ব্রেকডাউনও হতে পারে। হয়তো আরও দু’-তিন মাস পরে মা-বাবা যখন সারাদিনের জন্য বেরোবেন, বাচ্চার উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। সে নিজেকে একা রাখার যে অভ্যেস তৈরি করেছিল, সেটা একবার ভেঙেছে। আবার সেই অভ্যেস তৈরি করতে নিজেকে দ্বিতীয় বার ভাঙতে হবে। এর থেকে ক্ষোভ, বিরক্তি তো বাড়বেই। সে চঞ্চল হয়ে উঠবে, কথা শুনবে না, বায়না করবে... এমন নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়তো হতে হবে মা-বাবাকে।
কী কী করবেন
• বাচ্চার সঙ্গে কতটা সময় কাটাবেন, তা আগে স্থির করে নিন। পুরো দিনটা ভেঙে ক্যাটিগরি অনুযায়ী ভাগ করে নিতে হবে। ধরুন, সকালে এক ঘণ্টা ওর সঙ্গে থাকলেন। সে সময়ে ওকে পড়ালেন বা খাওয়ালেন। এর পরে যখন আপনার অফিসের কাজ শুরু হবে, তখন খুব প্রয়োজন না হলে ছোট সদস্যটির সেখানে না আসাই ভাল। যতই ইচ্ছে করুক, সে সময়টা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আগে যেমন অফিস যাওয়ার আগে ছোট সদস্যটির খাবার, পড়ার রুটিন গুছিয়ে দিতেন, সে ভাবেই গুছিয়ে দিয়ে নিজে একটা ঘরে ঢুকে যান।
• বাচ্চাকে বোঝাতে হবে, সেটা আপনার অফিসঘর। সুতরাং অফিস চলাকালীন সে ডাকতে পারবে না আপনাকে। কয়েকটা দিন বোঝালে, পরে ওর অভ্যেস হয়ে যাবে।
• একটা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ বোর্ড খুদেটিকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করতে পারেন। অফিসঘরে ঢোকার সময়ে সেটা দরজায় টাঙিয়ে দিন। ওকে বলুন, এখন এটাই আপনার অফিস। তাই আপনি অফিসে ঢুকলে সে কিন্তু আপনার কাছে আসতে পারবে না। ধীরে ধীরে সে ব্যাপারটা বুঝে যাবে। অপেক্ষা করতে শিখবে, ওই ঘর থেকে আপনার বেরোনোর জন্য।
• সন্তান ছোট হলে তাকে খাওয়ানো বা স্নান করানোর দায়িত্ব বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিন। আপনি অফিসে গেলে ও যার কাছে খেত বা ঘুমোত, তাকেই সেটা করতে দিন। এই কয়েক মাসের জন্য নতুন অভ্যেস তৈরি করবেন না।
টিনএজারদের ব্যাপারে সাবধান
বয়ঃসন্ধি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এই পর্যায়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, তা হল ব্যক্তিগত স্পেস। কারণ এ সময়ে ওদের মানসিক ও শারীরিক অনেক পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তন সে বুঝতেও শুরু করে। ফলে তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তার নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় চাই। সেই সময় ও জায়গা দুটোই সদ্য বড় হয়ে ওঠা মেয়ে বা ছেলেটিকে দিতে হবে। ওয়র্কিং পেরেন্টদের বুঝতে হবে, ওরা বাড়িতে অনেকটা সময় নিজের মতো থাকত। কিন্তু এখন অভিভাবকরা সব সময়ে থাকায়, তাদের সেই স্পেসটা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আপনি না বুঝেই ওর ব্রিদিং স্পেসে ঢুকে পড়ছেন। ওরা আপনাদের উপস্থিতি কী ভাবে সামলাবে বুঝতে পারছে না। এ ছাড়া সন্তানকে বেশি বকুনি দিলে কখনও তা চাপ সৃষ্টি করে।
অন্য আর একটি সমস্যা হচ্ছে, তাদের নিজেদের রুটিন বদলে যাচ্ছে। সে হয়তো বেলা তিনটে অবধি চ্যাট করে স্নান করে খেতে বসত। সেখানে মা-বাবা থাকায় তাকে নিয়ম মেনে বেলা একটার মধ্যে স্নান করে খেয়ে নিতে হচ্ছে। তার দিক থেকে পুরো রুটিনটাই ঘেঁটে যাচ্ছে। ফলে তার মনে মা-বাবা সম্পর্কে ক্ষোভ জমা হচ্ছে না তো? এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ ছেলে বা মেয়েকে নিয়মানুবর্তিতা শেখাতেই হবে। বোঝাতে হবে, নিয়ম মানা তার সুস্থতার জন্য ভীষণ জরুরি।
কী কী করবেন
• ওকে একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিন। সম্ভব না হলে ঘরের একটা দিকে ওর জন্য একটু আলাদা স্পেস রাখুন। সেই ঘরটাই বা ওই অংশটুকু ওর নিজের একটা রাজ্য বা ব্রিদিং স্পেস তৈরি করে দেবে।
• অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে বা ফোনে সে কার সঙ্গে গল্প করছে, কেন করছে সে বিষয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন না। প্রয়োজনে গল্পের ছলে কথা বলুন।
• গুরুতর কিছু না হলে ওদের কাজে সরাসরি বাধা দেবেন না। বরং এমন পরিস্থিতিতে আপনি পড়লে কী করতেন, সেই উদাহরণ সামনে রাখুন। তার পর তাকে ঠিক করতে দিন, সে কী ভাবে করবে।
• সর্বোপরি বাড়িতে খোলামেলা, হাসিঠাট্টার পরিবেশ তৈরি করে রাখা খুব জরুরি। মা-বাবার মধ্যে বিরোধ বা টেনশন সন্তানকে আরও এককোণে ঠেলে দেয়। সে মা বা বাবা... কারও সঙ্গেই তখন নিজের সমস্যা শেয়ার করতে চায় না। তাই সন্তানের উপরে নজর রাখুন, কিন্তু দূর থেকে। তার যেন মনে না হয় যে, তাকে বাড়িতে কেউ মনিটর করছে।
প্রত্যেকটা বয়সই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবাও ক্রমশ পরিণত হতে থাকেন। বাচ্চার কী দরকার আর কী নয়, তা কিন্তু মা-বাবাই সবচেয়ে ভাল বোঝেন। সন্তানের অবলম্বন না হয়ে, তাকে এমন ভাবে তৈরি করুন যেন সে স্বাবলম্বী হতে পারে।