নীরোগ থাকা, হাড়-দাঁত-চুল মজবুত ও মসৃণ করা, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা, হৃদ্স্পন্দন স্বাভাবিক রাখায় মিনারেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
রোগ প্রতিরোধ, জীবনীশক্তি ও শরীরের বাড়বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বলে ভিটামিনের খুব কদর। সেই অনুপাতে মিনারেল নিয়ে সচেতনতা একটু কম। কিন্তু শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলিতে ভিটামিন আর মিনারেল একসঙ্গে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই একটি ছাড়া অপরটির সুফল পাওয়া কঠিন। নীরোগ থাকা, হাড়-দাঁত-চুল মজবুত ও মসৃণ করা, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা, হৃদ্স্পন্দন স্বাভাবিক রাখায় মিনারেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সময়ে পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি হয় না। কিন্তু প্রয়োজনীয় পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবারটুকু খেতে মহিলাদের যেন অনীহা! তাই মিনারেলের অভাব জনিত নানা সমস্যা তাঁদের ভোগায়। নিয়ম মেনে খনিজে ভরা খাবার খেলেই শরীর ফিট থাকবে। ত্বক উজ্জ্বল থাকবে।
হাড়-দাঁত-পেশি ও মনের প্রহরী
সুস্থ থাকতে ষোলোটা অপরিহার্য খনিজ বা এসেনশিয়াল মিনারেল জরুরি। মেয়েদের জন্য ভীষণ জরুরি ন’টি মিনারেল— ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, আয়োডিন, তামা। এর মধ্যে ক্যালশিয়ামের সঙ্গে মেয়েদের বন্ধুত্ব খুবই গভীর। কারণ, এই খনিজ অস্টিয়োপোরোসিস ঠেকায়। পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘দাঁত আর হাড়ের মধ্যে ক্যালশিয়াম থাকে। কিছু শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার কারণে মেয়েরা ৩৫ পেরোলেই অস্থিসন্ধির ক্যালশিয়াম ডিপোজ়িট ক্ষয় হয়। ফলে তখন থেকেই হাঁটুর ব্যথা শুরু হয়ে যায়। সময়ে ব্যবস্থা না নিলে বেশি বয়সে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাই যায় না। পুরুষদের চেয়ে মহিলারাই বয়সকালে হাঁটুর যন্ত্রণা, হাড়ের ব্যথায় বেশি নাজেহাল থাকেন। খুঁড়িয়ে হাঁটেন। অল্প আঘাতেই হাড় ভাঙছে, দাঁত নড়ছে বলে অভিযোগ করেন। বয়স থাকতেই ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে এই ক্ষয় সামাল দিন। হাড়-দাঁতের বৃদ্ধি ছাড়াও ক্যালশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ুক্ষমতা, রক্ত তঞ্চন, পেশি স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখে। ক্যালরি বার্ন করে শরীর ছিপছিপে রাখে। দুধ, দই, পনির, ব্রকোলি, দানাশস্য ক্যালশিয়ামের ভাণ্ডার।’’
আরও পড়ুন: মিলন রাতে ‘সতীত্ব’ প্রমাণে কৃত্রিম রক্তের পিল অনলাইনে! নিন্দার ঝড় সমাজ জুড়ে
শরীরে ক্যালশিয়াম আত্তীকরণে সাহায্য করে ম্যাগনেশিয়াম। তা ছাড়া ম্যাগনেশিয়াম মাথাব্যথা, অনিদ্রা, ঘুমঘুম বা খিটখিটে ভাব দূর করে। চামড়ায় ভাঁজ পড়তেও দেয় না। সবুজ আনাজপতি, ডাল, ব্রাউন রাইস, বাদাম, চকলেটে ম্যাগনেশিয়াম ঠাসা।
অস্টিয়োপোরোসিস রুখতে, হাড় শক্ত রাখতে ফসফরাসও দরকার। ডিমের কুসুম, বাদাম, শুকনো ফলে এ খনিজ অঢেল।
ভাল থাকুক রক্তকণারা
ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে শরীরে ছড়িয়ে দেয় লোহিত রক্তকণিকা। সেগুলিই তৈরি করে আয়রন। ঋতুচক্রের সময়ে মেয়েদের শরীর থেকে আয়রন বার হওয়ার প্রবণতা থাকে। মহিলাদের অ্যানিমিয়া হওয়ার সেটি অন্যতম কারণ। এ রোগের লক্ষণ চোখমুখ বসে যাওয়া, চুল ঝরা, ক্লান্তি। এমন লক্ষণ দেখা দিলে আয়রনের মাত্রা কমেছে কি না, খোঁজ নিন। প্রাপ্তবয়স্ক নারীর খাদ্যতালিকায় দিনে ১৮ মিলিগ্রাম লৌহজাতীয় উপাদান থাকা জরুরি। পালং শাক, থোড়, মোচা, বাঁধাকপির সঙ্গে খান মাছ-মাংস, মেটে। কিউয়ি, জাম জাতীয় ফলেও প্রচুর আয়রন থাকে। সঙ্গে রাখুন ভিটামিন সি ভরপুর খাবার (টম্যাটো, লেবু, লঙ্কা, পেয়ারা)। ভিটামিন সি আয়রনের ‘এনহ্যান্সার’। আয়রনকে দ্রুত দেহের কাজে লাগাতে সাহায্য করে। রক্তকণিকা তৈরিতে তামাও জরুরি। বাদাম, বিনস, আলু, কোকোয় কপার পাবেন।
সুষম আহারে কিস্তিমাত
• ওষুধ নয়, ডায়েট ভাল: পুষ্টিবিদ অর্পিতা ঘোষ দেব বললেন, মিনারেল হল মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। খুব অল্প লাগে, কিন্তু গুরুত্ব অনেক। প্রকৃতির নানা খাদ্যের উপাদানে কম-বেশি পরিমাণে দরকারি খনিজ ছড়িয়ে আছে। বয়স, লিঙ্গভেদ, জীবনচর্যা ও কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী সুষম খাবার খেলেই মিনারেলের চাহিদা মিটে যায়। কিন্তু অনেকেই এই সুষম খাবার থেকে কিছু কিছু পদ বাদ দিতে থাকেন। কারও দুধ সহ্য হয় না, কারও মাছে গন্ধ লাগে, কেউ কলা পছন্দ করেন না। বাড়ন্ত বয়সে একটানা এমন করলে, পরবর্তী কালে খনিজ ঘাটতি জনিত অসুখ হবে। কারণ যে সময়ে শরীরের যে খাদ্যোপাদানের চাহিদা ছিল, তখন সেই পুষ্টি মেলেনি। ফলে তিরিশের আগেই অস্টিয়োপোরোসিস, হাঁটু-কাঁধে ব্যথা শুরু হবে। এমন কোনও সমস্যা হলে তখনই ব্যালান্সড ডায়েটের সঙ্গে অতিরিক্ত কোনও মিনারেল ডায়েট বা ট্যাবলেটের দরকার হয়। গবেষণা বলছে, সাপ্লিমেন্টারি খাবারের চেয়ে কম বয়স থেকে মিশ্রিত খাবার, সুষম আহারের অভ্যেস রাখলে বেশি উপকার। অসুখের জন্যও মিনারেল ডিজ়অর্ডার হতে পারে। তখন সাময়িক ভাবে ওষুধ খেয়ে বা সেই নির্দিষ্ট খনিজে ভরা খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে হবে। তার পরে ব্যালান্সড ডায়েটে ফিরে আসুন।
• একটু সাবধান: কিছু খনিজ ভিটামিনের সঙ্গে জোট বেঁধে শরীরের নানা কাজে লাগে। কিছু খনিজ আবার দরকারি খনিজকে শারীরবৃত্তীয় নানা কাজে সাহায্য করে। আবার কিছু মিনারেল অন্য মিনারেলকে কাজ করতে বাধা দেয়। যেমন খুব বেশি ক্যালশিয়ামে ভরা খাবার খেলে আয়রনের অভাব হতে পারে। কারণ, ক্যালশিয়াম শরীরকে লোহা শোষণ করতে দেয় না। প্রাতরাশ থেকে নৈশাহার পর্যন্ত প্রতিবার পেটভর্তি খাবার খেয়েই যদি কাপের পর কাপ চা-কফি খান, তা হলেও লোহার অভাবে রক্তাল্পতা হতে পারে। কারণ চা-কফির ট্যানিন বা ক্যাফেইন অন্য খাবারের আয়রন শরীর থেকে বার করে দেবে।
মুসুর ডালেও প্রচুর জ়িঙ্ক থাকে। রসুন, মাশরুম, ডিম, দুগ্ধজাতীয় খাবারেও রোজকার প্রয়োজন মেটানোর মতো জ়িঙ্ক পাবেন। জ়িঙ্কের অভাবে ডায়রিয়া হয়। অবসাদ আসে, খিদে কমে যায়।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের রোগ, থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে আয়োডিন। ফলে ওজন ঠিক রাখতে এর গুরুত্ব অশেষ।
বিপদে রক্ষা
শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা, পেশি সঙ্কোচন রোধ, হৃদ্যন্ত্রের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখার মতো জীবনদায়ী কাজ করে পটাশিয়াম। শুকনো ফল, ডাবের জলে এই মিনারেল ভাল পরিমাণে পাবেন। তেমনই গুরুত্বপূর্ণ আয়োডাইজ়ড নুন বা সোডিয়াম। নুন, ক্যানড খাবার, সামুদ্রিক মাছে এই খনিজ থাকে। এর মাত্রা ঠিক না থাকলে মাথাব্যথা বা ঘোরা, ঝিমঝিম লাগার মতো বিপজ্জনক উপসর্গ দেখা দেয়। হৃদ্যন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায়, ক্যানসার রুখতে, মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে সেলেনিয়াম কার্যকরী। টুনা জাতীয় সামুদ্রিক মাছ, মেটে, মুরগির মাংসে সেলেনিয়াম ভরপুর।
মা হওয়ার সময়ে
• ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের চাহিদা বাড়বে। এতে বাচ্চার হাড় পেশি মজবুত হয়।
• আয়রন ট্যাবলেট খেতে হয়। এতে অ্যানিমিয়ার ভয় থাকে না।
• আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খান। শিশুর মস্তিষ্ক সুগঠিত হবে।
বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আপনাকে সুস্থ সুন্দর কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। কাজেই, বয়স ও লিঙ্গভেদে নিজের শরীরের প্রয়োজন জেনে নিয়ে ভিটামিন মিনারেলে ভরা, সম্পূর্ণ আহারের অভ্যেস গড়ে তুলুন।