প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
এমন বিষয় অভিভাবকরা আড়াল করে রাখলেও বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এই দৃশ্য অপরিচিত নয়। কিন্তু ছোটদের মধ্যে এত রাগ কেন?
রাগ... ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, যদি তার বহিঃপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা না হয়। ইদানীং ছোট থেকে বড় সকলেরই রাগের পারদ চড়ছে। সন্তানের রাগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা-বাবারা। একরত্তির এত রাগই বা কেন হবে? তা অস্বাভাবিক ভেবে আরও কড়া হাতে হয়তো সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে, উত্তরোত্তর বাড়ছে সন্তানের রাগ। ফলে দূরত্ব বাড়ছে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের। মুখে-মুখে তর্ক, কোনও কথা না শোনা, কিছু ক্ষেত্রে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলা বা অবাধ্য কোনও আচরণও ক্রমশ রপ্ত করে ফেলছে খুদেরা।
রাগ হওয়া স্বাভাবিক?
আইআইটি খড়্গপুরের মনোবিদ দেবারতি আচার্য বলছেন, “ভয়, দুঃখ পাওয়ার মতো রাগও একটা আবেগ। ছোটদের রাগ হওয়াও যে স্বাভাবিক, সেটা অভিভাবককে বুঝতে হবে। তবে রাগ স্বাভাবিক হলেও তার অ্যাগ্রেসিভ বহিঃপ্রকাশ স্বাভাবিক নয়। আবেগ কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করব, সেটা শিখতে শিখতে আমরা বড় হই। ছোটবেলায় বাচ্চাটি হয়তো বুঝতে পারছে না, সে কী ভাবে তার রাগ সামলাবে। সে সময়ে উল্টে তার উপরে রেগে গেলে চলবে না। বরং সে যে রাগ করছে, সেটা বুঝে তার পাশে থাকতে হবে। ‘আমি বুঝতে পারছি তুমি রেগে গিয়েছ, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে,’ এইটুকু বললেও অনেক কাজ হয়। তার রাগটা যে বোঝার চেষ্টা করছেন, সেটা তাকে জানানো দরকার। এর পরে সন্তানকে রাগ নিয়ন্ত্রণ শেখাতে হবে।” তার আগে রাগের ধরনও বোঝা দরকার। ছোট থেকে টিনএজারদের রাগের বহিঃপ্রকাশ মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
এ ছাড়া শরীরেও পরিবর্তন দেখা যায়। বুক ধড়ফড় করা, গা গরম হয়ে ওঠা, কাঁপতে থাকা, হাত মুঠো হয়ে আসা... এগুলোও রাগের বহিঃপ্রকাশ।
এত রাগের কারণ কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “প্রি-স্কুল, স্কুল, বয়ঃসন্ধি... এই তিন ভাগে যদি ভাগ করে নেওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে এই রাগের বহিঃপ্রকাশ ছোট থেকেই ধীরে ধীরে হচ্ছে। একদম ছোট বাচ্চারা বায়না করে। তার যেটা চাই তো চাই-ই, সেটা খেলনা বা খাবার বা পছন্দের পোশাক হতে পারে। সেটা দিতে অভিভাবক অস্বীকার করলেই তারা হয়তো হাত-পা ছুড়ে কাঁদে, অনেকে মাটিতে বসে পড়ে। যে কোনও ভাবে মা, বাবাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সেই জিনিসটা কিনে দেন মা-বাবা।” পরিস্থিতি অনুযায়ী বাচ্চারা ক্রমশ ম্যানিপুলেট করতে শেখে। তবে রাগের কারণটাও বোঝা দরকার। “এখন বেশির ভাগ নিউক্লিয়ার পরিবারে মা-বাবাদের সময় কম আর ধৈর্যও কম। অনেক মা-বাবা-ই অন্য টাইম জ়োনে কাজ করেন। ফলে বাড়িতে থাকলেও সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। অনেকে চাকরির জন্য বাড়িতে সারা দিন থাকতে পারেন না। তখন কেয়ারগিভারের কাছে সন্তান বড় হয়। দাদু-ঠাকুমার সঙ্গও পায় না, পেলেও ছোট শিশুটি কী চায়, তাঁরা হয়তো বুঝে উঠতে পারেন না। দাদু-ঠাকুমা হয়তো গল্প বলে ভুলিয়ে রাখতে চান, কিন্তু বাচ্চাটির মন তখন টিভি বা ফোনের দিকে। দৈনন্দিন জীবনে ওরাও যে মানিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, ওদের ছোট-ছোট দুঃখ, একাকিত্বের ক্ষোভ জমা হচ্ছে... মা-বাবাকে কাছে পেলে তখন সেই আবেগ একত্রিত হয়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।”
সারা দিন পরে মা-বাবা বাড়ি ফেরার পরে সন্তান হয়তো মনে মনে তাদের সঙ্গে খেলতে চাইছে, কিন্তু মা-বাবা তখন ক্লান্ত শরীরে নিভৃতি চাইছে। এই যে রোজকার একটা সংঘর্ষ, এটাও অনেকাংশে দায়ী। তাই পারিবারিক গঠন কেমন, সেই অনুযায়ী বাচ্চা কী চাইছে... সেটা বুঝতে হবে। নিজের পরিস্থিতিও সন্তানকে বোঝাতে হবে। আপনি কেন বাড়িতে থাকতে পারছেন না, আপনার কাজের ধরন ওদের বলতে হবে।
আর একটা দিকও ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় মনে করালেন, সময় দিতে না পারায় অনেকেই সন্তানকে খেলনা, উপহার কিনে দিতে থাকেন। এতে তার চাহিদা বাড়তে থাকে। তার পর যখন সে এমন কিছু চাইল যা অভিভাবক দিলেন না, সে তখন রেগে যায়। তাই সময়ের বদলে উপহার দেওয়ার অভ্যেস করলে চলবে না।
সন্তান রেগে গেলে কী করবেন?
রাগের বহিঃপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে শারীরচর্চা, আঁকাজোকা, নাচ, গানের মতো শখ গড়ে তুলুন সন্তানের মধ্যে। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ধীরে ধীরে। জোর করে নয়।