গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
শহরে আন্দোলন চলছে। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের শুনানির পরে আলোচনার মোড় খানিক ঘুরেছে। তবে উত্তাপ কমেনি। এ দিকে, ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে এগিয়ে আসছে দুর্গাপুজো। আর ২১ দিন পেরোলেই মহালয়া। এত দিনে নিউ মার্কেট থেকে গড়িয়াহাট হয়ে হাতিবাগানে দরদাম করে কেনাকাটার ভিড় গুঁতোগুঁতির পর্যায়ে পৌঁছয়। পুজোর তিন সপ্তাহ আগের রবিবারে সেই ভিড়ে খানিকটা ভাটা। তবে কি এ বার জৌলুস কমবে পুজোরও? যে ভাবে ১৪ অগস্ট রাতের পর থেকে গতি বেড়েছে আরজি কর আন্দোলনের, তাতে প্রশ্ন উঠছে, দিন কুড়ির মধ্যে কি সব ভুলে জাঁকজমকের পুজোয় মাততে পারবে কলকাতা? না কি দুর্গাপুজোর রাত মলিন হবে আন্দোলনের আঁচে? এ শহরের পুজোকর্তারা কী মনে করেন? তাঁদের প্রস্তুতিতেও কি একটু ভাটা পড়েছে? শরতের শহর কি প্রতি বছরের থেকে অনেকটাই আলাদা দেখাবে এ বার?
আরজি কর আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল। তার খুবই কাছে ‘টালা বারোয়ারি’-র পুজো। প্রতি বার বেশ জাঁকজমক থাকে এখানকার পুজোয়। কিন্তু এ বছর পুজোর সময় কয়েকশো মিটারের দূরত্বে চিকিৎসকদের আন্দোলনও চলতে পারে। তা বলে পুজোয় জৌলুসে কোনও খামতি রাখতে চান না উদ্যোক্তারা। টালা বারোয়ারির সম্পাদক তথা কলকাতা দুর্গাপুজো ফোরামের এগ্জ়িকিউটিভ কমিটির সদস্য অভিষেক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘আমাদের প্রত্যেকেরই মনখারাপ। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ তো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই পুজোর ভাবনায় কোনও বদল আনতে চাইনি। পুজোর খাবারের স্টল বন্ধও করতে চাইনি। কারণ, ওই ক’টা দিনের উপর পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। প্রায় লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।’’ তা বলে কি আরজি করের সবচেয়ে কাছের দুর্গাপুজোয় প্রতিবাদ বন্ধ হয়ে যাবে! তেমনও নয়। অভিষেক বলেছেন, ‘‘কাকতালীয় ভাবে আমাদের এ বারের পুজোর ভাবনার সঙ্গে প্রতিবাদের ভাষা মিলে গিয়েছে। ভাবনাটা যখন ভাবা হয়েছিল, তখন তো এমন ঘটনা ঘটবে ভাবিনি। কিন্তু ঘটনাটা ঘটার পরে আমরা শিরদাঁড়া সোজা রেখে আর সেই ভাবনা থেকে সরে আসিনি।’’ আপাতত পুজোর জৌলুসে বড় কোনও বদল না আনলেও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পুজোর কিছু উদ্যাপন বন্ধ রাখা হতে পারে বলে ভেবে রেখেছেন উদ্যোক্তারা। অভিষেক জানিয়েছেন, প্রতি বার সবাইকে নিয়ে ভোগ খাওয়ার আয়োজন হয়। সেটা বন্ধ রাখা হতে পারে। বিসর্জনের জাঁকজমক, সিঁদুরখেলার উৎসবও অল্পে সেরে নেওয়া হতে পারে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে।
আরজি কর-কাণ্ডে প্রতি দিনই প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে শহর। প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে মূলত সরকারের বিরুদ্ধেই। সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন কেউ। কোথাও আবার ‘দুর্গার ভান্ডার’-এর সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দিচ্ছে পুজো কমিটি। মুদিয়ালির ‘আমরা ক’জন’ ক্লাবের তরফেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারি অনুদানের ৮৫ হাজার টাকা। কেন ফেরানো হচ্ছে? মুদিয়ালির পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা মহম্মদ মোখতার বলছেন, ‘‘আমরা সরকারের সাহায্য নেব না বলে জানিয়ে দিয়েছি। আমাদের পুজোর মূল ভাবনাও বদলে দিয়েছি। আমাদের পুজোয় এ বার কোনও উদ্যাপন, অনুষ্ঠান হবে না। এ বারের পুজোর থিমও ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান। তাই হয়তো আমাদের বিদ্যুতের অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু আমাদের পাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তেমন যদি কিছু হয়, তাঁরা সাহায্য করবেন মণ্ডপে আলো জ্বালাতে।’’
বাগবাজারের প্রতিমার এমন সাজ কি এ বারও দেখা যাবে? ছবি: সংগৃহীত
অনুদান ফেরানো মুদিয়ালি পুজোর জৌলুস বাদ দিলেও বাগবাজার সর্বজনীনের সম্পাদক গৌতম নিয়োগী চান ‘পুজোটা পুজোর মতো হোক’। আরজি কর থেকে কিছুটা দূরেই বাগবাজার সর্বজনীন। উত্তর কলকাতার যে পুজোগুলি নিয়ে দর্শনার্থীদের উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি, বাগবাজার তার মধ্যে অন্যতম। সম্পাদক গৌতম জানিয়েছেন, পুজোর জৌলুসে কোনও খামতি রাখতে চান না তাঁরাও। তা বলে এমন নয়, তাঁরা সুবিচার চান না। গৌতম বলছেন, ‘‘আন্দোলনকে আমরাও সমর্থন করি। কিন্তু পুজোর সঙ্গে আমরা সেটাকে মেলাচ্ছি না।’’
একই ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে পুজোকে মেলাতে চান না বিজেপির নেতা এবং বৌবাজারের বড় পুজোর কর্তা সজল ঘোষও। উত্তর কলকাতার ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সজলের পুজো বলে পরিচিত সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার। যার আর এক নাম লেবুতলা পার্কের দুর্গাপুজো। সরকারি অনুদান কোনও দিনই তাঁরা নেন না। তবে এ বার আরজি কর আন্দোলন নিয়ে প্রথম থেকেই সরব সজল। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তবে তিনিও চান না পুজোর জাঁকজমক কমাতে। সজল বলেছেন, ‘‘এই আবহে উৎসব করতে সত্যিই মন চায় না। দুর্গাপুজো না করলে যদি আরজি করের নির্যাতিতার অপরাধীদের শূলে চড়ানো হয়, তবে আমিও বলব উৎসব না করতে। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে, দুর্গাপুজোকে ঘিরে বাংলায় ৫০ হাজার কোটি টাকার যে ব্যবসা হয়, সেটা পশ্চিমবঙ্গে অন্য কোনও ক্ষেত্রে হয় না। দুর্গাপুজোর থেকে বড় শিল্প আর কিছু নেই পশ্চিমবঙ্গে। তাই সেই শিল্প এবং ব্যবসার উপর ভরসা করে থাকা মানুষগুলির কথাও আমরা যেন ভুলে না যাই। প্রতিবাদ আমরা করব এবং চাইব উৎসব ওই আন্দোলনকে যেন আরও সংগঠিত করে।’’
আরজি করে চিকিৎসকদের প্রতিবাদ চলছে। ছবি: সংগৃহীত।
আন্দোলন যে সংগঠিত হচ্ছে না, তা-ও নয়। ইতিমধ্যেই মহালয়ার ভোর আর পুজোর রাতে বিশেষ কর্মসূচির পরিকল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের একাংশ। তবে এ শহরের পুজো উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তেমন না হলেই মঙ্গল। পুজোয় রাশ টানা মানে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে রাজ্যের অর্থনীতি এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থানে। তাই সুবিচার চাইতে গিয়ে কিছু মানুষের প্রতি যেন আমরা অবিচার না করে ফেলি!’’
মূলত বিজ্ঞাপনদাতাদের কাঁধে ভর দিয়েই বড় পুজোগুলির জাঁকজমকের টাকা ওঠে। পুজোকর্তাদের অনেকে বলছেন, আন্দোলনের আবহে এ বছর পিছু হটেছেন বেশ কিছু বড় বিজ্ঞাপনদাতা। তবে কলকাতার পুজো ফোরামের এগ্জ়িকিউটিভ কমিটির সদস্য অভিষেকের মতে, আন্দোলনের মুখে পুজোর উন্মাদনা এ বার একটু থমকে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিকও হচ্ছে। অভিষেক বলছেন, ‘‘গণেশ চতুর্থীর পর থেকে কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দ ফিরতে দেখা যাচ্ছে পুজোর বাজারে। কুমোরটুলিতেও গিয়ে জেনেছি, প্রতিমার বরাত কম আসেনি এ বার। এটা ঠিকই যে, কিছু বিজ্ঞাপনদাতা আন্দোলনের আবহে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরাও ফিরবেন।’’ কিন্তু পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয়, আন্দোলন যদি চলতেই থাকে, তা হলে কি বিজ্ঞাপনদাতারা ফিরবেন? টাকা না এলে কি পুজোর জৌলুস শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পারবেন পুজোর উদ্যোক্তারা? জবাবে অভিষেক বলেছেন, ‘‘সে ক্ষেত্রেও পুজোর জৌলুস কমবে না। কারণ, ব্যবস্থা সব হয়েই গিয়েছে। এখন বিজ্ঞাপনদাতারা পিছোলে, হয়তো দেনার মুখে পড়তে হবে উদ্যোক্তাদের। তার পরেও বড় কিছু না ঘটলে পুজোর জাঁকজমকে তেমন টান পড়ার কথা নয়।’’
পুজোর এখনও মাসখানেক বাকি। শীর্ষ আদালতের শুনানিও হবে আবার। কলকাতা সে দিকে তাকিয়ে।