‘প্রি ওয়েডিং’এ বর-কনের পছন্দ কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি। ছবি- সৌরদীপ ঘোষ
অনেকেরই ধারণা বিয়ের পর বর-কনে, দু’জনের জীবনেই আসে আমূল পরিবর্তন। আগের জীবন কেমন ছিল, তা ধরে রাখতে ইদানীং প্রি ওয়েডিং ফোটোগ্রাফির চল হয়েছে। এক এক যুগলের জীবনের তো এক এক রকম গল্প থাকে, তাই সেই গল্পগুলিকে কেন্দ্র করেই বদলে যায় প্রি ওয়েডিং ছবি তোলার ধরন। প্রি ওয়েডিং ফোটোশুটের একেবারে শুরুর দিকে সকলের ধারণা ছিল এক রকম। আগে কলকাতার রাস্তায়, মাঠ-ময়দানে, গঙ্গার ধারে বা নৌকায়, ইতিউতি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে দেখা যেত হবু বর-কনেদের। কিন্তু সব হবু দম্পতিদের রূপকথা যদি ময়দান বা কলকাতার চেনা রাস্তা থেকেই শুরু হয়, সে ক্ষেত্রে সকলের জীবনের গল্পই এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যাবে। গল্পে নতুনত্ব থাকবে না। তাই ছবি বা ভিডিয়ো শুট করার ক্ষেত্রে ছবি তুলিয়েদের নানা রকম পরীক্ষা-নিরিক্ষা করতে হয় প্রতিনিয়ত। কলকাতার তেমনই কয়েক জন চিত্রগ্রাহক জানালেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা।
শহরের আনাচ-কানাচে এমন অনেক হবু দম্পতিদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় শুটের জন্য। ছবি- সৌরদীপ ঘোষ
বছর দশেক আগে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনোর পর আর ওই দিকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কর্মসূত্রে শহরের বাইরে ছিলেন দু’জনেই। এত দিন পর আবার যাওয়ার সুযোগ হল ‘প্রি ওয়েডিং’ ফোটোশুটের দৌলতে। কারণ, দিওতিমা আর রক্তিমের প্রেমটা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। তার পর বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট, বাগবাজার ঘাটে বিকেলের সূর্যাস্ত পেরিয়ে ডুবতে বসা প্রেম যখন পরিণতি পাচ্ছেই, তখন সেই শুরুর দিন থেকে এত দিনের পুরনো ঘটনাগুলিকেই ছবি বা ভিডিয়োর মাধ্যমে ছোট করে ধরে রাখতে চায় ওরা। শুধু রক্তিম আর দিওতিমা নয়, ওদের মতো এমন অনেক জুটিকেই প্রতিদিন শহরের আনাচ-কানাচে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এই ‘প্রি ওয়েডিং’ শুট করার জন্য।
এক্কেবারে বিদেশি এই সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক কোনও ধারণা ছিল না বর-কনেদের। কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিদেশি প্রি ওয়েডিং ছবি, ভিডিয়ো দেখিয়ে, বুঝিয়ে হবু বর-কনেকে রাজি করাতে হত। কিন্তু এখন পুরো চিত্রটাই বদলে গিয়েছে। বিয়ের ছবির যে বাজেট, তার কাছাকাছি বা ক্ষেত্রে বিশেষে তারও বেশি বাজেট ধরা থাকে ‘প্রি ওয়েডিং’ শুটের জন্য। বহু দিন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত সৌরদীপ ঘোষ বলেন, “বহু দিন সম্পর্কে ছিলেন এমন জুটিদের প্রি ওয়েডিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রেমের গল্প বলাটাই এখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই গল্প শুনে আমরা জায়গা বা পোশাক নির্বাচন করি। তাদের জীবনের সঙ্গে কোন শহরের যোগ রয়েছে সেই সব শুনে আমরা একটা গল্প বলার ধরন ঠিক করি। তবে কলকাতার বেশির ভাগ জুটি কিন্তু ভিডিয়োর চেয়ে এখনও ছবিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। অবশ্য তার জন্য শুধু জড়তা নয়, বাজেটও একটা বড় কারণ।”
হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস সাক্ষী ‘প্রি ওয়েডিং’-এ। ছবি- সৌরদীপ ঘোষ
প্রেম করতেন যখন, তখন এক বার প্রিন্সেপ ঘাট থেকে নৌকো চড়েছিলেন অমিত এবং তিথি। সে একেবারে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড় তিথির। বাড়িতে না জানিয়ে এসেছেন বলে যত না ভয় ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলেন সাঁতার না জেনে নৌকোয় উঠে। ওদের মতো অনেকেরই প্রেমপর্বে মনে রাখার মতো একটি জায়গা কলকাতা প্রিন্সেপ ঘাট। কিন্তু সেই ঘাটে এখন আর হবু দম্পতিদের শুট করতে দেওয়া হয় না। আবহে বেজে ওঠে না ‘পিউ বোলে পিয়া বোলে’। ‘ওয়েডিং বেল্স’-এর ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “আসলে নিরাপত্তার কারণেই সেখানে শুট করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। আর নৌকোয় উঠতে গেলেও লাইফ জ্যাকেট পরে যেতে হয়। শুটের জন্য যা খুবই অসুবিধাজনক। তাই ইচ্ছা থাকলেও সেখানকার কোনও গল্প আমরা বলতে পারি না। অথচ কিছু দিন আগে বেনারসের ঘাটে এই একই ভাবে নৌকায় হবু দম্পতিদের ছবি তুলে এলাম। তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। এই রকম সমস্যার সম্মুখীন হলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়।”
বিয়ের জন্য যে ক’দিন ছুটি পাওয়া যায়, তার মধ্যে আলাদা করে প্রি ওয়েডিং শুট করা সম্ভব হয় না অনেকের। অনেকের আবার বাড়ি থেকে নানা রকম আপত্তি থাকে। তাই এই প্রি ওয়েডিং-এর পুরো বিষয়টিকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিয়ের পরবর্তী সময়ে। যাতে সময় এবং পরিবারের আপত্তি দুই-ই না থাকে। এ ছাড়া প্রি ওয়েডিং ছবির সঙ্গে এখন চল হয়েছে ভিডিয়োগ্রাফিরও। কলকাতার মধ্যে শুট করতে না চাইলে কাছেপিঠে মন্দারমণি, শান্তিনিকেতন বা দার্জিলিং তো রয়েছেই।
কিছু দিন আগে হলেও উত্তর কলকাতার অলিগলিতে, পুরনো ভাঙা বাড়িতে শুট করতে দেখা যেত যুগলদের। কিন্তু প্রেমের গল্প বুননের ধারা এক রকম যাতে না হয়, তাই নিত্যনতুন জায়গার সন্ধান করতে হয় ছবি শিকারিদের। ‘দ্য ওয়েডিং ক্যানভাস’-এর শিলাদিত্য দত্ত বলেন, “কলকাতার যত্রতত্র শুট করাও এখন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তার জন্য আলাদা করে অনুমতি নিতে হয়। তাই এই শহরে ছবি তোলা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। অথচ দিল্লি, মুম্বই বা দেশের অন্যান্য শহরে কিন্তু আমাদের এই রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। তার পর বাজেটও বিরাট বড় একটা ব্যাপার। কোনও রাজবাড়িতে শুট করতে গেলেও তা ব্যয়সাপেক্ষ। আবার বিয়ের আগে এত সময় দিতে পারেন না হবু বর-কনে, তাই প্রি ওয়েডিং আমরা এখন বিয়ের পর তাদের সময়-সুযোগ মতো শুট করে থাকি।”
দুই পরিবার থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে ঠিক হলেও প্রি ওয়েডিং শুট করতে চান অনেকে। ছবি- সৌরদীপ ঘোষ
দুই পরিবার থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে ঠিক হলেও প্রি ওয়েডিং শুট করতে চেয়েছিলেন দুই ২৪ পরগনার ঈশান এবং মৃত্তিকা। কিন্তু তাঁদের জীবনে তেমন কোনও গল্প নেই, শুধু কয়েক বার কলকাতার কয়েকটি ক্যাফে এবং রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া ছাড়া। ছবি তোলার ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা না হলেও জড়তা কাটিয়ে ভিডিয়ো করতে বেশ সমস্যা হয় তাঁদের। ‘ড্রিম আর্টিসান’ ফোটোগ্রাফির বিল্বনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই সব ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মতো করে একটা গল্প তৈরি করি। ক্যাফেতে বসেই নানা রকম পরিকল্পনা করতে করতে জড়তা কেটে যায়। কলকাতার অনেক ক্যাফেতেই আজকাল শুট করা হয়। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিশেষ অনুমতি নিয়ে শুট করি আমরা।”