অসহ্য গরমের হাত থেকে সাময়িক স্বস্তি দিতে দিয়েছে ক্ষণিকের ঝড়বৃষ্টি। তবে ‘দীর্ঘ দহনবেলা’ ফুরোতে এখনও ঢের দেরি। তার মধ্যেই নানা কাজে নিয়মিত বাইরে বেরোতেই হয় যাঁদের, তাঁদের হিটস্ট্রোক সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। বিশেষ করে শিশুদের কিংবা যাঁরা এই গরমে খোলা জায়গায় দিনভর ডিউটি করেন (নিরাপত্তাকর্মী কিংবা ট্রাফিক পুলিশ)। সানস্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ ও তার প্রতিকার জানা থাকলে, তার মোকাবিলা করাও হবে সহজ।
কেন হয় সানস্ট্রোক?
সাধারণত ড্রাই হিট, অর্থাৎ শুকনো গরমই হিটস্ট্রোক বা সানস্ট্রোকের মূল কারণ। বাতাসে হিউমিডিটি বেশি থাকলে, অর্থাৎ ময়েস্ট হিট এই স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের মতে, মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে যে থার্মোস্ট্যাট রয়েছে, তার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয় দেহের তাপ। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে সেই হাইপোথ্যালামাসে সরাসরি প্রভাব পড়লেই হয় হিটস্ট্রোক বা সানস্ট্রোক। দেহতাপ অস্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছয়, বন্ধ হয়ে যেতে পারে ঘাম নিঃসরণও। শরীরে জলের অভাব এই অবস্থা ত্বরান্বিত করে।
কী করে বুঝবেন সানস্ট্রোক?
বড়দের ক্ষেত্রে:
* ঝিমুনি ভাব, অসংলগ্ন কথা
* প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া ও রং গাঢ় হয়ে যাওয়া
* পেশিতে টান ধরা (মাসল ক্র্যাম্প), মাথা ধরা
* শরীর অত্যধিক গরম হওয়া, লাল হয়ে যাওয়া, ঘাম না বেরোনো
* বমি
* হার্টবিট বেড়ে যাওয়া
* অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে:
* খাবারে অনীহা
* মেজাজ বিগড়ে যাওয়া
* প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া ও গাঢ় রং
* মুখের তালু, জিভ শুকিয়ে যাওয়া, চোখের স্বাভাবিক আর্দ্রতা শুকিয়ে যাওয়া
* অবসন্নতা
* কোনও জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ
এই ধরনের উপসর্গ দেখা গেলেই ধরে নিতে হবে সেই ব্যক্তি বা শিশুটির হিটস্ট্রোক হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করার পরে দরকার হলে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। যদিও ছোটদের ত্বক স্বাভাবিক ভাবেই আর্দ্র থাকার কারণে তাদের হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তুলনায় কম।
অবিলম্বে যা যা করণীয়
* ছায়ায় নিয়ে গিয়ে লম্বা করে শুইয়ে দিতে হবে।
* পরনের জামাকাপড় যতটা সম্ভব খুলে দিতে হবে, যাতে শরীর থেকে লীনতাপ বেরিয়ে যায়।
* চোখে-মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতে হবে। ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা-হাত-পা স্পঞ্জ করে দিতে হবে।
* পুরোপুরি হুঁশ আসার আগে কখনওই রোগীকে জল খাওয়ানোর চেষ্টা করতে নেই। কারণ এতে খাদ্যনালির বদলে শ্বাসনালিতে জল চলে গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে। রোগী একটু ধাতস্থ হওয়ার পরেই তাঁকে জল খাওয়ানো উচিত।
* ইনট্রা-ভেনাস স্যালাইন পুশ করতে পারলে রোগী সবচেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আগাম সতর্কতা
প্রথমত এবং প্রধানত, শরীরকে আর্দ্র রাখতে হবে যে করেই হোক। সারা দিনে বারেবারে জল খেতে হবে।
তেতেপুড়ে এসেই ঠান্ডা জল ঢকঢক করে গলায় ঢালা যাবে না। ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘গরম থেকে এসে ঠান্ডা জল খেলে সর্দি-গর্মি হবে না, যদি সেই জল গ্লাসে ঢেলে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে বা স্ট্রয়ের সাহায্যে খাওয়া হয়। ফ্যারিংসে সরাসরি ঠান্ডা জল ঢাললে তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তনে থার্মাল শক লাগে, যা থেকে ফ্যারেঞ্জাইটিস হতে পারে।’’
রাস্তায় দীর্ঘক্ষণের জন্য বেরোলে সঙ্গে ওআরএস কিংবা নুন-চিনির ছোট পাউচ রাখা জরুরি। খাওয়ার ঠিক আগে জলে মেশাতে হবে তা। আগে থেকে বোতলে গুলে এই সলিউশন ক্যারি করা উচিত নয়। কারণ, বেশিক্ষণ এটি ফেলে রাখলে ফার্মেন্টেশনের সম্ভাবনা বাড়ে। যা অনেকক্ষণ রেখে খেলে ডায়েরিয়া পর্যন্ত হতে পারে। লেবুজলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। লেবুর ভিটামিন সি জলে গুলে রেখে দেওয়ার অনেকক্ষণ পরে খেলে তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই সন্তানকে গ্লুকোজ় জাতীয় সলিউশন বোতলে গুলে ব্যাগে দেওয়ার পরিবর্তে সঙ্গে সঙ্গে গুলে খাওয়ান। ওআরএস তৈরির সময়ে প্যাকেটের নির্দেশ অনুযায়ী মেশাবেন। এক লিটার জলে এক প্যাকেট মেশানোর নির্দেশ থাকলে তা-ই মেশাতে হবে। কম করে তৈরি করতে চাইলে হাফ লিটার জলে হাফ প্যাকেট গুলে তৈরি করতে পারেন। এই সলিউশনের ঘনত্ব ঠিক না হলেও ডায়েরিয়া হতে পারে বলে জানালেন ডা. মণ্ডল।
রোদে বেরোলে ছাতা, সানগ্লাস (ইউভি রে প্রোটেক্টেড) ব্যবহার করতে ভুলবেন না। সাধারণ সানগ্লাসের মধ্য দিয়ে সূর্যরশ্মি যাওয়ার সময়ে তার ওয়েভলেংথ পাল্টে গিয়ে আরও গরম করে তোলে। তাতে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। তাই সানগ্লাস বা চশমা যেন সব সময়ে ইউভি রে প্রোটেক্টেড হয়। সুতির হালকা জামাকাপড় পরাই বাঞ্ছনীয়। ঘাম হলেও যাতে তা বাষ্পীভূত হতে পারে সহজে।
প্রস্রাবের রং পাল্টানো বা প্রস্রাবের পরিমাণ কমে আসতে দেখলেই সতর্ক হতে হবে। শরীর যত হাইড্রেটেড থাকবে, সানস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু ততই কমবে।