পড়ার চাপ সামলাতে রাত জাগতেই অভ্যস্ত ক্লাস নাইনের অর্ণব। বছর বারোর রিয়া আবার রাতের খাওয়া সেরে বাবা-মায়ের সঙ্গে টিভি দেখে।
অর্ণব, রিয়ার মতো ছোটরা এখন বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত জাগছে। কখনও পড়ার চাপ। কখনও বদলে যাওয়া জীবনধারা। এ ভাবেই টান পড়ছে ওদের ঘুমে।
সম্প্রতি স্কুলপড়ুয়াদের ঘুমের সমস্যা নিয়ে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১১-১২ বছর বয়সি ৮৭ শতাংশের ঘুমের ব্যাঘাত হয়। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের প্রায় ৯৩ শতাংশ এই সমস্যায় ভুগছে।
অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণ একাধিক। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, পড়ার চাপের পাশাপাশি বাবা-মা রাত পর্যন্ত জেগে থাকায় সন্তানেরাও ঘুমোতে চাইছে না। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের রাত জেগে ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে আড্ডা দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাই সপ্তাহে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ছ’ঘণ্টা ঘুম কম হচ্ছে তাদের।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অপর্যাপ্ত ঘুমের জেরে খিটখিটে মেজাজ, ভুলে যাওয়া, মনঃসংযোগের অভাবের মতো নানা সমস্যা স্কুলপড়ুয়াদের
মধ্যে দেখা দিচ্ছে। মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেলের কথায়, ‘‘স্মৃতিশক্তি এবং মনঃসংযোগ বাড়াতে পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। মানসিক বিকাশের জন্য অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমোনো দরকার।’’
কম বয়সিদের ঘুমের ব্যাঘাত ভবিষ্যতে আরও রোগ ডেকে আনার ঝুঁকি বাড়ায়, জানাচ্ছেন নিদ্রারোগ বিশেষজ্ঞ সৌরভ দাস। তাঁর কথায়, ‘‘১১ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের দশ ঘণ্টা ঘুম হলেও ক্ষতি নেই। দীর্ঘদিন কম ঘুমোলে হৃদরোগ, ডায়বিটিসের মতো সমস্যা দেখা দেবে।’’
শুধুই শারীরিক সমস্যা নয়। মানসিক বিকাশের ঘাটতির পাশাপাশি অপর্যাপ্ত ঘুম ব্যবহারেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যা আরও জটিল সমস্যা তৈরি করবে বলে জানাচ্ছেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার। তাঁর কথায়, ‘‘অপর্যাপ্ত ঘুম মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ কমায়। এই হরমোনের জেরেই মানুষ স্থির থাকতে শেখে। অপর্যাপ্ত ঘুমের জেরে অস্থিরতা বাড়বে। ফলে কোনও কাজ নিপুণ ভাবে করতে পারবে না। সেটা আবার আর এক মানসিক চাপ তৈরি করবে। এ ভাবেই চক্রাকারে সমস্যা বাড়বে।’’
পড়ার চাপে অপর্যাপ্ত ঘুম মানতে নারাজ রাজ্য স্কুলশিক্ষা দফতরের পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘সিলেবাস কমিটিতে মনোবিদেরা ছিলেন। প়়ড়ুয়াদের মানসিক চাপের দিকে নজর রেখেই নতুন সিলেবাস তৈরি হয়েছে।’’ বরং অভিভাবকদের অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন আইসিএসই স্কুল অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক নবারুণ দে। তিনি জানান, ২০১৬ সালের আগের পাঠ্যক্রমে পড়ুয়াদের চাপ পড়ত। এখন সেটা কমেছে। কিন্তু স্কুলে একটা অধ্যায় পড়ানো হলে বাড়িতে তিনটে অধ্যায় পড়িয়ে প়ড়ুয়াকে অগ্রিম তৈরির চেষ্টা চলে।
অভিভাবকদের একাংশ কিন্তু মনে করছেন, বছরের প্রথমে পড়ানো নিয়ম মেনে হলেও বছরের শেষের দিকে একসঙ্গে একাধিক বিষয় পড়ানো হয়। যার জেরে চাপ তৈরি হয়। যদিও শিক্ষা দফতরের কর্তারা জানান, পড়ুয়াদের এই চাপ কমাতে শিক্ষকদের মডিউল প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
অধিকাংশ স্কুল কর্তৃপক্ষের মতে, পড়ুয়াদের পর্যাপ্ত ঘুমের খেয়াল রাখতে হবে অভিভাবকদের। যেমন লা মার্টিনিয়রের সচিব সুপ্রিয় ধর বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য সম্পদ, এ ধারণা শিশু মনে তৈরি করার দায়িত্ব অভিভাবকদের।’’ তাঁর সঙ্গে সহমত দ্য হেরিটেজ স্কুলের প্রিন্সিপাল সীমা সাপ্রু। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক শিশুদের কাছেই কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন থাকে। যা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। সন্তানের পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য কী ব্যবস্থা করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত অভিভাবকের।’’