—প্রতীকী ছবি।
কখনও মনে হয়, স্মার্টফোন আর কম্পিউটারের গভীর কোনও প্রকোষ্ঠে বসে এক প্রেতাত্মা আমাদের অনুসরণ করছে। সিনেমাহলে পুরনো পাড়ার দিদির সঙ্গে দেখা হল, ফেরার সময় আক্ষেপ করছেন, ইস, নম্বরটাই নেওয়া হল না। কিছুক্ষণ পরেই সমাজমাধ্যমে দেখলেন, ফ্রেন্ড সাজেশনে দিদিটির প্রোফাইল! বাড়িতে সোফা কেনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল বা নিজের মনেই কিনবেন ভাবছিলেন। মোবাইল খুলে দেখলেন, হাজারো অফারের সোফার বিজ্ঞাপন ছেয়ে গিয়েছে।
নিশ্চয়ই জানেন, এই অশরীরী নজরদারের নাম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম মেধা। স্মার্টফোনের মাধ্যমে গুগল ম্যাপ বেয়ে গিয়ে, কার সঙ্গে কার দেখা হচ্ছে সেই তথ্য টুকে নিয়ে তার সঙ্গে আপনার সোশ্যাল প্রোফাইলকে জোড়ার চেষ্টা করছে অবিরত। ফোনে কান পেতে কথাবার্তা শুনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় আপনার জীবনের জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ছে নতুন জমানার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। জীবন যত ডিজিটাল হয়েছে, এআই নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা তত বেড়েছে। এসেছে ‘এআই’-সৃষ্ট নতুন প্রোগ্রাম চ্যাটজিপিটি বা চ্যাট জেনারেটিভ প্রিট্রেনড ট্রান্সফর্মার। বলা হচ্ছে, এই প্রোগ্রাম প্রথমে প্রচুর মানুষের কাজ কাড়বে। তার পরে, যন্ত্রমেধা তার কৃত্রিমতা ঝেড়ে ফেলে স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠে মানুষকেই চালনা করতে শুরু করবে। সভ্যতা সঙ্কটে পড়বে। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জীবনের গঠন আমূল পাল্টে দেবে এআই? ঠিক কী হতে চলেছে? এআই ভিনগ্রহে আমাদের উপনিবেশ স্থাপন করে আসবে, নাকি পৃথিবীর রাস্তায় ভরে যাবে মানুষের মৃতদেহ?
প্রযুক্তির অন্দরে
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ছাপাখানার আবিষ্কার, অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লব বা গত শতাব্দীতে কম্পিউটারের আবির্ভাবও জীবন ও সমাজে প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল। আজ এআইয়ের বিরুদ্ধে হলিউড যে ভাবে ধর্মঘট করছে, কম্পিউটার চালু করার সময় ব্যাঙ্ককর্মীরাও এ ভাবেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আগের এই সব প্রযুক্তিবিপ্লব শেষমেশ সভ্যতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে, কিছু জীবিকা বিলুপ্ত হলেও অন্য অনেক পেশার রাস্তা খুলেছে। এআই নিয়ে তবে এমন ত্রাহি ত্রাহি রব কেন? উত্তর জানতে, প্রযুক্তিটির প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সৈকত মিত্র রাজ্যে প্রথম এআই কোর্স চালু করেন। তিনি বললেন, “যা আমরা দেখি, শুনি, তার তথ্যভাণ্ডার থাকে আমাদের মস্তিষ্কে। যে নতুন তথ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুর মাধ্যমে মাথায় প্রবেশ করল, তা মগজের মধ্যে বিশ্লেষিত হয় বা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলানো হয়। তার থেকে কী করব না করব, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি। মানুষের শরীরও কিন্তু ‘লজিকাল কম্পিউটার সিস্টেম’-এর মতো কাজ করে। সেই সব লজিক, গাণিতিক সমীকরণ কম্পিউটার প্রোগ্রামে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, কম্পিউটারে তথ্য ভরে সেগুলোর বিশ্লেষণও শুরু করা হয়েছে। এটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্নায়ুতন্ত্রে তথ্য ইলেকট্রোকেমিক্যাল সিগন্যাল রূপে চলাচল করে। কম্পিউটারে তথ্য যাচ্ছে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল হিসেবে। মানুষের যেমন স্নায়ু, কম্পিউটারের তেমন তার। যত দিন যাচ্ছে, কম্পিউটারের তথ্য ধারণের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। সে সেগুলো ‘প্রসেস’ করতে পারছে, তা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে, কম্পিউটার বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যাচ্ছে। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, আগামী দিনে কম্পিউটারের স্টোরেজ ক্ষমতা মানবমস্তিষ্কের চেয়েও বেড়ে যাবে। তৈরি হবে সুপার ইন্টেলিজেন্স। আরও বেশি তথ্য, বেশি অনুভূতি, আরও বেশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কম্পিউটারের মধ্যে চলে আসবে। ফলে, ভয় তৈরি হচ্ছে যন্ত্র মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই দাবি উঠেছে, এআই গবেষণাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
“চ্যাটজিপিটি হল ‘ওপেনএআই’ প্রতিষ্ঠানের একটা ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’। আগে কোনও বিষয়ে গুগল সার্চ করলে সার্চ ইঞ্জিন সে বিষয়ক তথ্য এক জায়গায় জড়ো করত। সেগুলো কোনটা কাজের, কোনটা কাজের নয়— ঝেড়েবেছে নিয়ে আমরা নিবন্ধ লিখতাম বা সৃষ্টিশীল কাজে লাগাতাম। নতুন মডেলে প্রয়োজনটুকু জানালেই হল, সিস্টেমই তথ্য জোগাড় করে তা সংশ্লেষ করে ওই গোটা নিবন্ধটাই তৈরি করে দিচ্ছে। ছবি আঁকছে, কবিতা লিখছে। লেখা-আঁকা পছন্দ না হলে, কোনও সংশোধন থাকলে, চ্যাটজিপিটি সেটা দেখেশুনে নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলছে। অটো ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে, নিজের ‘বেটার ভার্শন’ তৈরি করছে।” ওপেনআই চ্যাটজিপিটি-কে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার পর এমন মডেল গুগল, ফেসবুকও চালু করছে। টেক-জায়ান্টদের মধ্যে এই নিয়ে রেষারেষি চলছে।
মুদ্রার দু’টি পিঠ
এই ‘রেস’ দেখেই প্রমাদ গুনছেন বিশেষজ্ঞরা। এআইয়ের ‘গডফাদার’ রূপে পরিচিত জিওফ্রে হিন্টন বলেছেন, এই প্রযুক্তিকে লাগাম না পরালে পরিণতি ভয়ঙ্কর। অধ্যাপক মৈত্র বললেন, “এআই নিয়ে সব দেশ মিলে এককাট্টা হয়ে একটি সীমানা স্থির রাখা উচিত। এর যথেচ্ছ প্রয়োগে সামরিক শক্তি চরম আকার ধারণ করতে পারে। যুদ্ধবাজ দেশগুলো এআই-কে আরও উন্নত করার আগুনেখেলা খেললে, বাকি বিশ্বকে তারা কব্জা করে নেবে। আবার এমনও হতে পারে, তাদের শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অন্য দেশ আরও বুদ্ধিধর রোবট বানাল, আর সেই রোবট মানবজাতিকেই দাস বানিয়ে ফেলল! তবে, এআইয়ের সংযত প্রয়োগে কাজ সহজ, নিখুঁত হবে।” এখনই তো রোবট দিয়ে সার্জারি করা হচ্ছে। মানুষ চিকিৎসকের হাত কাঁপলেও, রোবটের ক্ষেত্রে সেই ভয় নেই। সে রকমই এআই-কে অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সহকারী হিসাবে ব্যবহার করলে কাজের চাপ লাঘব হবে। সেই উদ্বৃত্ত সময় ও মেধা অন্য গঠনমূলক কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু, পুরো কাজই যন্ত্র করে দিলে, অসংখ্য মানুষের চাকরি যাবে।
আগেও দেখা গিয়েছে, কিছু পেশার প্রয়োজন ফুরোলে, কিছু নতুন পেশাও তৈরি হয়। যেমন, এআই-কে ঠিক ভাবে চালনা করার জন্য, যন্ত্রাংশের দেখভালের জন্যই তো অনেক লোক লাগবে। এআই গলা নকল করতে পারে, ব্যাঙ্কের পাসওয়ার্ড জেনে ফেলতে পারে, দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে, ভুয়ো খবর ছড়াতে পারে। কাজেই সাইবার-নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও কাজ বাড়বে। যদি ভবিষ্যতে গৃহসহায়ক, গাড়িচালক ইত্যাদি পেশা এআই দখল করে নেয়, তা হলে এদের সন্তানদের নতুন স্মার্ট-দুনিয়ার অন্য পেশার প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য সুগম হবে।
আতঙ্ক ছড়িয়েছে বৌদ্ধিক পেশাগুলির অঙ্গনেও। যন্ত্র স্কুল-কলেজে পড়া বুঝিয়ে দেবে, সৃষ্টিশীল লেখালিখি, আঁকা-ডিজ়াইনও সামলে দেবে। এআই অ্যাঙ্কর খবর পড়ছেন, কনটেন্ট রাইটারের চাকরি কমছে। একটি মিডিয়া হাউসের সম্পাদকীয়ের প্রথম অনুচ্ছেদ লিখে তাক লাগিয়েছে এআই। অনেকের মতে, একাধিক সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘ডেটা’ হিসেবে ‘ইনপুট’ পাওয়ার পর সে সেই ধরনের একটা ‘প্রডাক্ট’ বানিয়েছে। অর্থাৎ অনুকরণ মাত্র। এআই মাধ্যমে যে সব লেখা ও ছবি পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে অনেকেই এক ধরনের যান্ত্রিকতা-দোষও পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞের ধারণা, অটো লার্নিংয়ের মাধ্যমে সেই ত্রুটিটুকুও এআই শুধরে নেবে।
শুভবুদ্ধি জিতবে?
অধ্যাপক মৈত্র বলছেন, “এআই নিয়ে সকলের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবেই এর সুবিধে কাজে লাগাতে মানুষ তৎপর হবেন। কর্মী ছাঁটাইয়ের বদলে, খবরের উপস্থাপনা, বিশ্লেষণ, পড়াশোনাকে আরও আকর্ষক করতে এআই ব্যবহার করা যায়। কুম্ভীলকবৃত্তি, জালিয়াতি রুখতে ইতিমধ্যেই এআই দারুণ কার্যকর। যে ব্যক্তি বা ছাত্র যে বিষয়ে দুর্বল, তার সেই খামতি পুষিয়ে দেবে এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট। যেমন, পুঁজিবাজারে অজ্ঞ মানুষ শেয়ারে টাকা লাগাতে এআই-এর সাহায্য নিতে পারবেন। এআই দিয়ে লেখক বা শিল্পীর প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলার পরিবর্তে, সেই মানুষটি যাতে এআইয়ের সহায়তায় নিজের সৃষ্টিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন, সেই দিকে লক্ষ থাকুক।
আসলে এআই-এর উপকার, অপকার দুই-ই মহাবিশ্বের মতো অনন্ত। স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের ভার্চুয়াল রাস্তায় হাতের আঙুলে ভর করে হাঁটতে হাঁটতে বাস্তবের পৃথিবীতে এক নিদারুণ সন্ধিক্ষণে চলে এসেছি আমরা। সামনে দুটো রাস্তা। একটি রাস্তায় মিলবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। অন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। দুয়ারে রূপকথা অথবা প্রলয়।