‘রক’ সম্রাট ব্রায়ান অ্যাডাম্সের গানে ভাসল শহর কলকাতা। ছবি: সংগৃহীত।
ঠিকানা— কোচপুকুর, পোঃ: হাটগাছিয়া, থাকদাঁড়ি। কিন্তু তত ক্ষণে তা হয়তো শিকাগো শহরতলি। বুলেভার্ড বেয়ে গাড়ি ঢুকে যাওয়ার কথা ‘ভেন্যু’তে। কিন্তু থমকাল জাঁকালো ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ। লালবাতির নিষেধে গাড়ি রেখে অটো বা টোটো সম্বল। এর পর যেখানে পৌঁছচ্ছে জনস্রোত, তত ক্ষণে তা কলকাতা নামক মহানগরের চেনা চৌহদ্দি নয়। কনসার্ট এ শহর কম দেখেনি, কম দেখে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রকপুরুষের আবির্ভাব সে হিসাবে কলকাতায় প্রথমই বলা যায়। কানাডিয়ান রকসঙ্গীত শিল্পী ব্রায়ান অ্যাডাম্সের মাপের রক-তারকা কি কলকাতায় অনুষ্ঠান করেছেন? এ শহরের জ্যাজ়, ব্লুজ়, বা কয়েক কদম এগিয়ে পশ্চিমি মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্য থাকলেও পেল্লায় মাঠে হিমজ্যোৎস্নায় অঙ্গ ভিজিয়ে গায়ে গা দিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার মানুষ কি রক কনসার্ট শুনেছে এ শহরে? এই সব দোলাচল বুকে নিয়ে টোটো বা অটোবাহিত জনস্রোত যেখানে প্রবেশ করছে, তা এত কাল দূরের ভিডিয়োতেই দেখা। ওপেন বার থেকে বারবিকিউ ঘেরা মাঠে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ছে…
… ভিড় বাড়ছে অচেনা এক কলকাতার। যে কলকাতা বইমেলার, যে কলকাতা রাত দখলের, যে কলকাতা রাতজাগা ডোভার লেনের, তার সঙ্গে এর মিল প্রায় নেই। উলুখুলু দাড়ি, পনিটেল-পুরুষের টিশার্টে উঁকি দিচ্ছে ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’, ঈষৎ রুপোলি চুলের নাগরিকা লেদার-দুরস্ত ফ্যাশনে অচেনা, ধূম থেকে কড়া পানীয়— নিষেধ নেই কোনও কিছুরই। এর মধ্যেই ঘনিয়ে উঠছে এক বিশেষ বয়সি মানুষের ভিড়। রুখু দাড়িতে সাদা ছোপ, বাইফোকাল অথবা প্রগ্রেসিভ চশমার ফাঁক দিয়ে দিব্যি দেখা যায় বয়সের ত্রিকোণমিতি, বেশির ভাগ নারীর ক্ষেত্রেও অরুণকুমার সরকারের কবিতা ‘যৌবন যায়, যৌবন বেদনা যে যায় না’-গোছের এক অনির্দেশ্য ধুসরিমা। আর তাঁদের পাশটিতেই গা ঘেঁষে জায়গা করে নিচ্ছেন উনিশ-বিশ-তিরিশ-বিয়াল্লিশ। এত ‘রকহেড’ কলকাতায় ছিলেন, ভাবা যায় না! এমন উক্তি কানে এলেও আসতে পারে, প্রায় সেই সময়েই মঞ্চে ঘোষণা শুরু। ব্রায়ানের আগে ঈশান নামের এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ভারতীয়ের গান। ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা ৬টা পেরিয়েছে। লাউঞ্জ মিউজ়িকের আজকের ধাঁচার সেই গান দক্ষতার সঙ্গে গাইলেও জনসমুদ্রে খানিক সংক্ষোভ— “কখন? কখন? আর কত ক্ষণ?”
শিকাগো, বেঙ্গালুরুতে দু’বার ব্রায়ানের অনুষ্ঠান শুনেছেন পর্ণশ্রীর সুজয় রায়। কিন্তু নিজের শহরে ব্রায়ানকে শোনার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চাননি। বোনকে নিয়ে এসেছেন কনসার্টে। উসখুস দেখে খানিক স্বগতোক্তির স্বরেই বলে ফেললেন, “রাত আটটার আগে ব্রায়ান উঠবেন বলে মনে হয় না।” অনেকগুলো কান ঘুরে গেল সে দিকে। দু-দু’বার ‘ব্রায়ান ফেরত’ বলে কথা! অভিজ্ঞতার দাম আছে বই-কি! ঈশানের গানের পরেও লম্বা সময় স্পিকারে গান বাজতে দেখে যথারীতি কলকাতা আবার কলকাতাতেই। “এখনও যদি না ওঠেন, কখন বাড়ি যাব!”… “খিদে পাচ্ছে? রোল খা”… “অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত-টা কেন যে ঝোলাচ্ছে না জায়ান্ট স্ক্রিনে” এ সবের মধ্যেই কে যেন বলে উঠলেন— “বাপি বাড়ি যা।’’ কে বাপি, কেন সে বাড়ি যাবে, এই সব কূট প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে মঞ্চের আলোর রং বদলাতে শুরু করেছে। জনসমুদ্রের চূড়ায় ফসফরাসের মতো মোবাইল ঝলসে উঠছে, মঞ্চ থেকে কয়েকটা পেল্লায় সাইজ়ের বল কারা যেন ছুড়ে দিলেন দর্শকের মাথার উপর, সেই বলগুলি হাত থেকে হাতে লাফাতে লাফাতে সাদা স্ক্রিনে ফুটে ওঠা গাড়ির ছবি থেকে যেন লাফ দিলেন সাদা পোশাকের ছায়াপুরুষ। ড্রামস, গিটার আর কিবোর্ডের ঝনাৎকারে ১৯৮৪‘সমবডি’ উল্লাস! ঝলসে উঠছে মোবাইলস্রোত, তরল ক্রিস্টালের দীপ্তি ধরে থাকা হাতের অরণ্যে একা পোস্টম্যান ব্রায়ান, পর পর ছুড়ে দিলেন ‘এইটিন টিল আই ডাই’ এবং তাঁর অন্যতম ব্লকবাস্টার ব্যালাড ‘প্লিজ় ফরগিভ মি’। ঠোঁট থেকে ঠোঁটান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে— “ইট স্টিল ফিলস আওয়ার ফার্স্ট নাইট টুগেদার/ ফিলস লাইক দ্য ফার্স্ট কিস”। প্রথম চুম্বনের মাদকতাকে কণ্ঠে তুলে আনার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যে কলকাতার রয়েছে, তা তত ক্ষণে সম্ভবত বুঝে গিয়েছেন ৬৫ বছর বয়সি গায়ক। অপেক্ষার ভিতরের অজস্র বর্ণালি খেলা করতে শুরু করেছে তখন জায়ান্ট স্ক্রিনে। সাদা-কালো। অসম্ভব প্রতীকী যে সেই মুহূর্ত। ধূসরের দিকে ঢলে যাওয়া বয়সের রকহেড থেকে শুরু করে যে কিশোরীটি গত কাল সবে প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়েছে, সবাই মিলেমিশে একাকার।
ধূসরের দিকে ঢলে যাওয়া বয়সের রকহেড থেকে শুরু করে যে কিশোরীটি গত কাল সবে প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়েছে, ব্রায়ানের গান শুনে সবাই মিলেমিশে একাকার। ছবি— অভিনন্দন দত্ত।
নিজের পরিচিতি জানালেন নিজের নাম বলেই। জানালেন, পাঁচ বছর আগে প্রয়াত বাবাকে নিয়ে লেখা গানটির কথা। ‘শাইন আ লাইট’ গানটি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠেছে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট। স্মৃতিকাতরতাকে আরও খানিক দীর্ঘায়িত করলেন ব্রায়ান, গত বছর প্রয়াত ‘কুইন অফ রক অ্যান্ড রোল’ টিনা টার্নারের সঙ্গে তাঁর গান ‘ইটস ওনলি লাভ’ গেয়ে। তার আগেই অবশ্য গেয়ে ফেলেছেন তাঁর আর এক ব্লকবাস্টার ‘হেভেন’। কোনও অতিরিক্ত কথা নেই। কিথ স্কটের গিটারের সঙ্গে কখনও বাজাচ্ছেন হারমোনিকা। ইলেক্ট্রনিকা শোনা জ়েন জি থেকে আবক্ষ শ্মশ্রুশোভিত প্রৌঢ় রক-রসিকেরাও বাক্রুদ্ধ সেই বাদনে। টিনার স্মৃতি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ‘রকাবিলি’র একটি গুচ্ছ। নাচতে আগ্রহীদের উদ্দেশে ব্রায়ান জামা খুলে ফেলতে বলার সঙ্গে সঙ্গে জনস্রোতের একাংশ পুরুষ ডিসেম্বরের নিউ টাউনের হিমস্পর্শের তোয়াক্কা না করেই ওড়াতে লাগলেন জামা। কারও কারও কাঁধে উপবীতও দৃশ্যমান তখন। দৈত্যাকার পর্দায় মঞ্চ আর শ্রোতাপুঞ্জের ঝিলিমিলি স্থানবদল।
অস্থায়ী ওয়াচ টাওয়ার বেয়ে উৎসাহী, অত্যুৎসাহীর দল অনেকখানি উঠে গিয়েছে। পেল্লায় সাউন্ডবক্সের উপর বাবু হয়ে বসে থাকা এক বছর নয়েকের ওস্তাদ মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত শূন্যে ছুড়ছে অবিরাম। তার মা জানালেন তাঁর একবগ্গা ব্রায়ান-প্রীতির কথা। সেখান থেকেই রক-রপ্রেম চুঁইয়ে নেমেছে অপত্য স্নেহের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। ‘ক্লাউড’ নাম্বার নাইন’-এ জনগর্জন তুঙ্গে। কিন্তু তার পরেও তো আরও শিখর থাকার কথা। নিরাশ করলেন না ব্রায়ান। ‘এভরি থিং আই ডু/ আই ডু ইট ফর ইউ’ ব্যালাডের ঝাপট অনেকের বুকেই যেন খুলে দিল স্মৃতির হাজারদুয়ারি। হারিয়ে যাওয়া গ্লোব প্রেক্ষাগৃহে ‘রবিন হুড: প্রিন্স অফ থিভস’ দেখার স্মৃতি ঝনকে উঠল। মনে পড়ে গেল সেই তির ছোড়ার দৃশ্য, যেখানে নাকি ক্যামেরাটিকেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিরের ডগায়। তিরের ‘পয়েন্ট অফ ভিউ’ থেকে সেই গান যে ঘায়েল করেছিল একটা গোটা প্রজন্মকে, তা মালুম পাওয়া গেল নতুন করে। গোটা মাঠে তখন সুরতরঙ্গ… ব্রায়ান শুধু সঙ্গত করছেন আর হারিয়ে যাওয়া গ্লোব, তার ফ্রন্ট স্টল, রিয়ার স্টল, ব্যালকনি যেন সময়যানে চড়ে ফিরে এসে গাইছে সেই ‘পাওয়ার ব্যালাড’। নস্ট্যালজিয়া থেকে ছিটকে আসা কমলহিরের দ্যুতি ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই সব কথা, যা বলা হয়নি অথচ বলার ছিল। মনে পড়তে পড়তেও পড়ছে না দুর্মর ১৯৯১-এর লিন্ডসে পেরিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ২০ টাকায় কেনা ‘বুক ক্যাসেট’-এর বুকের ভিতর ডুবে থেকে আগুনভরা শ্রাবণগানের ভিতরে ব্রায়ান ছাড়াও, রবিন হুড ছাড়াও যেন ডুবে ছিল কারও ডাগর চোখের ‘আনত দিঠির মানে’।
‘কাটস লাইক আ নাইফ’, ‘বেস্ট অফ মি’ হয়ে শেষ গান হিসাবে ‘স্ট্রেট ফ্রম দ্য হার্ট’ ধরলেন ব্রায়ান।। ছবি— অভিনন্দন দত্ত।
গোড়া থেকেই গুঞ্জন ছিল, কখন আসবে সেই ক্ষণ। ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’। এ শহরের এককালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলির অন্যতম। হয়তো ব্রায়ানের জীবনেরও সবচেয়ে বড় মাইফলক। সেই উত্তাল রকতরঙ্গে ডুবাইলেন-ভাসাইলেন ব্রায়ান। কোনও খেদ রাখলেন না সেই গায়নে। শ্রোতা-গায়কের বিভাজন আবার লোপ পেল। সময় বলে যে আদতে কিছুই হয় না, ঊনসত্তর সালের সেই গ্রীষ্মের হলকায় নিজেকে সেঁকে নিয়ে কলকাতা জানাল ‘বেস্ট ডেজ় অফ মাই লাইফ’-এর কথা। সেই গান তখন তার শরীরী আবেদন ছাপিয়ে ছায়ায় ভর করে স্মৃতিরেখায় ঝাপট মারছে। উপস্থিত সকলেই জানছেন ‘ইট ওয়াজ় নাউ অর নেভার’। এই মুহূর্তকালই সত্য, অর্গ্যাজ়মের মতো সত্য, আকাশের মতো সত্য। ‘বাকি সব আকাশের ও পারে, গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে…
‘কাটস লাইক আ নাইফ’, ‘বেস্ট অফ মি’ হয়ে শেষ গান হিসাবে ধরলেন ‘স্ট্রেট ফ্রম দ্য হার্ট’। ব্রায়ানের হৃদয়ের সঙ্গে সরাসরি হৃদয় মেলাল শহর। আবার এক ‘পাওয়ার ব্যালাড’-এ গলে গেল হৃদয়াকাশ। এই গলনেরই তো কথা ছিল! মাস তিনেক আগে থেকে টিকিট কেটে দমবন্ধ অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে যা যা পাওয়ার ছিল, সবই উপচে উঠল ঘণ্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায়। তবু কলকাতা জানে, শেষ মানে নিছক শেষ নয়। ব্রায়ানও বোধ হয় টের পেলেন শহরের একান্ত স্বরকে। শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক্কেবারে একা গাইলেন ‘অল ফর লাভ’। আবার এক ‘ক্লাসিক’ সিনেমার স্মৃতি। ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। রড স্টুয়ার্ট, স্টিং আর ব্রায়ানের ত্রয়ীর নিবেদন ছিল সেটি। এখানে এক প্রায়ান্ধকার মঞ্চে একা মধ্য-ষাটের যুবক। কলকাতাও তার হাইড্রান্ট উপচে ওঠা স্মৃতিকে উজাড় করে গাইল সেই গান। ‘দ্যাট ইটস অল ফর ওয়ান অ্যান্ড অল ফর লাভ… আই উইল ডিফেন্ড, আই উইল ফাইট… আই উইল বি দেয়ার হোয়েন ইউ নিড মি…’
তবে কিছু আক্ষেপও কি থেকে গেল না? শহরের নিজস্ব রকব্যান্ড ‘হিপ পকেটস’ বা নব্বইয়ের ‘শিবা’-র কনসার্টে অথবা বহমান সময়ে সুফি সঙ্গীতের আসরেও আওয়াজের প্রাবল্য খানিক বেশিই থাকে। ব্রায়ানের কনসার্টে সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দে যেন খামতি ছিল। ঠিক যতখানি প্রাবল্যে ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ বা ‘কাটস লাইক আ নাইফ’ শোনার কথা ছিল, ততখানি যেন হল না। আর শেষ দিকে কি একটু তাড়াহুড়ো করলেন শিল্পী? সংক্ষেপিত হল কি চেনা গানগুলির দৈর্ঘ্য?
হিমস্তব্ধ ডিসেম্বরের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আবার অটোরিকশ সওয়ার জনতা কি মাথার উপরে তাকাল এক বারের জন্যও? আধখাওয়া চাঁদের রং একটু বেশিই লালচে যেন। ‘ব্লাড মুন’-এর কথা তো নয়! তবে কি থাকদাঁড়ির ও পারে, নিয়নমণ্ডলের ও পারে উপগ্রহটিও এত ক্ষণ শুনছিল প্রজন্ম ব্যবধান একাকার করে দেওয়া এই কনসার্ট? না কি শহরের প্রথম কনসার্টেই দোলা লাগা রক্তের আভা মেখে ব্রায়ানকে প্রত্যভিবাদন জানাতে চাঁদও শামিল হল ‘অল ফর ওয়ান’ আর ‘ওয়ান ফর অল’-কে মনে রেখে?