গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছোটবেলায় স্কুল পালানো গানের কারণে। সেই গানকে ভালবেসেই পড়াশোনা আর বেশি দূর এগোয়নি। গানপাগল সেই ছেলেটার বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তিনি এখন শিক্ষক। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই খ্যাতনামা। কারও কারও নাম তো দেশজোড়া! সেটাই তো চেয়েছিল মহাজন পদ গাওয়া সেই ছোট্ট ছেলেটা। নিজের আশ্রমে কচিকাঁচাদের ডেকে এনে গান শেখানোর শুরুটা যদিও বেশি পুরনো নয়। বছর পাঁচেক হবে। তবে গুরুমুখী বিদ্যা দান করে কোনও পয়সাই নেন না বাবু ফকির। তাঁর আশ্রমে সঙ্গীতের অবাধ আনাগোনা চলতেই থাকে! চলতে থাকে শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়াও। তিনি খুঁজে খুঁজে ছাত্রছাত্রীদের আশ্রমে নিয়ে আসেন যে!
কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়ক ধরে নতিডাঙা হয়ে গোরভাঙা মোড়। সেখান থেকে একটা রাস্তা গ্রামের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। রাস্তার দু’ধারে বাঁশবাগান আর পুকুর। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে ‘দাতাবাবা লালন আশ্রম’। ঢোকার মুখে গেটের উপরে মাধবীলতার ঝাড়। আশ্রমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই কাঁঠালগাছের গোড়ায় একটা ছাগল বাঁধা। সেই ছাগলটাকেই পরম যত্নে গাছ থেকে কাঁঠাল পাতা ভেঙে খাওয়াচ্ছেন ছ’ফুট দুই ইঞ্চির বাবু ফকির। কাগজেকলমে নাম নুরুল ইসলাম। ছোটবেলায় মা নুরুন্নেসা বিবি আদর করে ডাতেন ‘বাবু’। সেই নামেই লোকসঙ্গীতের দুনিয়ায় পরিচিতি তাঁর। প্রথম দেখাতেই জানতে চান, ‘‘কী সাধু, কী খবর?’’ অপরিচিতকে ঘনিষ্ঠতায় বেঁধে ফেলার এমন মোক্ষম সম্বোধন!
ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো ফেরতা দিয়ে পরা। উপরে লম্বা ঝুলের গেরুয়া পাঞ্জাবি। তার উপরেই গলিয়ে নিলেন দোতারাটা। জমে উঠল গল্প। সঙ্গে গানও— ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে, যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে…।’ বাবু ফকির নমাজ পড়েন না মন্দিরেও যান না, ভালবাসেন মানুষকে। ভরসা রাখেন লালনের সেই গানে, ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার...।’ মানুষকে গুরু মেনে মনসুর ফকিরের তত্ত্বাবধানেই গান গাওয়া। পাশাপাশি গানের তত্ত্বতালাশ। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘‘প্রথম জীবনে জামাইবাবুর যাত্রাদলের ভাঙা হারমোনিয়াম ২৫০ টাকায় সারাই করে বাজানো শুরু করেছিলাম। গুরু মনসুর ফকিরের হাত ধরে প্রথম কলকাতার হাতিবাগানে দলীয় গানের অনুষ্ঠানে যাই। দলগত ভাবে কত পেয়েছিলাম জানো! ছ’শো টাকা।’’
পারিবারিক কারণেই লোকসঙ্গীত, লালনগীতি ও কীর্তনকে ভালবেসে ফেলেন বাবু। নিজস্ব চিত্র।
গোরভাঙা অত্যন্ত প্রত্যন্ত হলেও প্রত্যেক বার শীতের মরসুমে এখানে ‘বিশ্ব ফকিরি উৎসব’ হয়। সে উৎসব সব অর্থেই আন্তর্জাতিক স্তরের। গল্পের ফাঁকে গোরভাঙার ইতিহাসও শোনালেন বাবু ফকির। গোরভাঙাতেই তাঁর জন্ম। লোকমুখে প্রচলিত, প্রায় ৫০০ বছর আগে ভৈরব নদীর চোরা স্রোতে আফগানি খানদের বাণিজ্যসূত্রে আগমন। সেই সময়ে গোরভাঙায় ছিল ব্রাহ্মণদের বাস। আফগানদের সঙ্গে ধীরে ধীরে ওই ব্রাহ্মণদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়। এখনও এখানকার ফকিরদের পরিবারে শাখা-সিঁদুরের রীতি রয়েছে। বাবু ফকিরের বাবা শামসুদ্দিন খান একতারা ও ডুগি বাজিয়ে গান গাইতেন। বাবুর মেজো দাদা বাংলা লোকসঙ্গীতের খ্যাতনামা শিল্পী গোলাম ফকির। বোন সেলিনা বিবিও লোকসঙ্গীত জগতের খ্যাতনামী। ফলে পারিবারিক কারণেই লোকসঙ্গীত, লালনগীতি ও কীর্তনকে ভালবেসে ফেলেন বাবু। লালনের গান রয়েছে, ‘ভাব দিয়ে খোলো ভাবের তালা, দেখবি রে মানুষের খেলা...’, সেই তত্ত্বেই আজও আত্মনিমগ্ন পঞ্চাশোর্ধ্ব গানপাগল বাবু ফকির।
লালনই বলেছিলেন, ‘আমার আপন খবর আপনার হয় না…।’ বাবু ফকিরের জীবনও খানিকটা তেমন। তাঁর দুই ছেলে। প্রথম জনের স্বপ্ন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করবেন। ছোট থেকেই তার প্রস্তুতিতে মগ্ন তিনি। আর অন্য জন পারিবারিক জমিজমা নিয়ে চাষের কাজে ব্যস্ত। বার বার চেষ্টা করেও বাবু ফকির এঁদের কারও হাতেই দোতারা কিংবা ডুগি তুলে দিতে পারেননি। বাবু ফকির চেয়েছেন তাঁদের ফকিরি ঘরানার পরম্পরা বজায় রেখে তাঁর সন্তানেরাও আসুক লোকসঙ্গীতের জগতে। সে কারণেই ছোটবেলায় হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন ছোটছেলেকে। কিন্তু বাবাকে লুকিয়ে সে হারমোনিয়াম বিক্রি করে খেলার জুতো কিনে ফুটবল মাঠে নেমে পড়েছিল সে। এ কথা স্ত্রীর মুখে শুনতে পেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন বাবু। অনেক চেষ্টা করেও দু’জনকে সঙ্গীতমুখো করতে না পেরে একপ্রকার হাল ছেড়ে দেন বাবা।
কিন্তু বাবুর চিন্তা যায় না। তাঁদের দীর্ঘ দিনের এই সঙ্গীত পরম্পরা কার মাধ্যমে পৌঁছবে আগামী প্রজন্মের কাছে? পরামর্শ দিলেন স্ত্রী। সেই মতো বাবু সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের গুরুমুখী বিদ্যা, সঙ্গীত সাধনা— সবটাই এলাকার নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু গুরুমুখী বিদ্যা দান করে পয়সা নিতে নারাজ বাবু। এ বার সমাধান বাতলালেন তাঁর দাদা গোলাম। গোরভাঙার এক আখড়ায় একচিলতে ঘরে শুরু হল বাবু ফকিরের ‘অবৈতনিক বাউল শিক্ষা কেন্দ্র’। ২০১৭ সালে স্মার্ট ফোন আর নেটমাধ্যমের দৌলতে বাবু ফকিরের যোগাযোগ তৈরি হল জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। নিজের প্রচেষ্টাতেই জেলা থেকে জেলান্তরের গণ্ডি ছাড়িয়ে খুঁজে আনতে থাকলেন খুদে প্রতিভাদের। এমনকি, বিভিন্ন অনাথ আশ্রম থেকেও তাঁর বিনা বেতনের স্কুলে ভিড় বাড়তে থাকল। শুরুর দিনে ছিল মাত্র পাঁচ জন। প্রাঞ্জল, প্রত্যুষ, পিউ, ইমন ও সুপ্রিয়া। বাবু ফকিরের একটাই উদ্দেশ্য— লালনগীতি, সুফি সঙ্গীতের সম্প্রীতির বাণী ও সুর দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে দেওয়া বিশ্ব দরবারে। তাঁদের কয়েকশো বছরের প্রাচীন বংশীয় সঙ্গীত ঘরানা বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এই খুদেদের গলায়। পাঁচ জন দিয়ে শুরু। বর্তমানে বাবু ফকিরের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। আছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত। সাপ্তাহিক ক্লাস শেষে ছাত্রছাত্রীদের জলখাবারের ব্যবস্থা নিজ হাতেই করে থাকেন বাবু ফকির। কোথা থেকে আসে অর্থের জোগান? মৃদু হেসে বাবু বলছেন, ‘‘সবই মালিক জুটিয়ে দেন। সারা বছর গান করে যা পয়সা পাই, তাতে না কুলালে দুই ছেলে জোগাড় করে। স্ত্রীর ধনেও হাত পড়ে মাঝেমাঝে।’’
ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো ফেরতা দিয়ে পরা। উপরে লম্বা ঝুলের গেরুয়া পাঞ্জাবি। তার উপরেই গলিয়ে নিলেন দোতারাটা। জমে উঠল গল্প। নিজস্ব চিত্র।
বাবু ফকিরের শিক্ষাগুরু মনসুর ফকির তাঁর শিষ্যের এমন ভূমিকায় আবেগ-আপ্লুত। তিনি বলেন, ‘‘মহাজনি গান এক প্রকার গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু-শিষ্য পরম্পরা এ ভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে। বাউল মতে শিষ্যত্ব গ্রহণের বাইরে এ ভাবেও যে গুরুমুখী বিদ্যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছনো যায়, বাবু তা দেখিয়ে দিয়েছে।’’
ছোট ভাইয়ের এমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাবু ফকিরের মেজ দাদা গোলাম ফকির পুরনো স্মৃতি আওড়াচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সবার আদরের বাবু, ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে গান করত। চেষ্টা করেও তাকে স্কুলে পড়াতে পারেনি কেউ। তবুও বাবু আজ শিক্ষক। দেখে খুব আনন্দ হয়।’’
সেই অর্থে বাবু ফকিরের প্রথম ছাত্র প্রাঞ্জল বিশ্বাসের গানে এই মুহূর্তে গোটা দেশ মুগ্ধ। একটি সর্বভারতীয় বিনোদন-চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোয়ে প্রাঞ্জল অন্যতম সেরা গায়ক। তাঁর লোকসঙ্গীতের জাদু মোহিত করছে সকলকে। প্রাঞ্জলের ওই পথ চলার শুরুটা কিন্তু বাবু ফকিরের হাত ধরেই। প্রাঞ্জলের করিমপুরের বাড়িতে গিয়ে, তার বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে তাকে নিয়ে এসেছিলেন আশ্রমে। একই রকম ভাবে মুর্শিদাবাদের রাশেদুল, নদিয়ার পিউ তাঁর অন্যতম শিক্ষার্থী। প্রাঞ্জল এই মুহূর্তে ওই রিয়্যালিটি শোয়ের জন্য মুম্বইয়ে। তাঁর মা বললেন, ‘‘গোরভাঙার দাতাবাবা লালন আশ্রমে বেশ কিছু দিন সঙ্গীতচর্চা করেছে প্রাঞ্জল। বাবু ফকিরই ওকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে গান শিখিয়েছেন।’’
বর্তমানে বাবু ফকিরের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। আছেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত। নিজস্ব চিত্র।
গত চার বছর ধরে বাবু ফকিরের আশ্রমে মেয়েকে গান শেখাতে নিয়ে আসেন দিঘলকান্দির বিকাশচন্দ্র দাস। তাঁর কথায়, ‘‘মহাজনি গান শেখানোর ইচ্ছাতেই মেয়েকে এখানে নিয়ে আসা। শুধু গান শেখানো নয়, তার ব্যাখ্যাও বদলে দিতে পারে জীবনদর্শন । সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই স্কুলে আমাদের মতো সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা শেখার সুযোগ পাচ্ছে, এটাই বড় কথা।’’ আর বাবু ফকিরের খুদে ছাত্রী অদিতি দাস বলছে, ‘‘বাবুজেঠু যখন বকে, তখন ভয় করে। আবার যখন আদর করে, খুব আনন্দ হয়। অনেক জায়গায় বাবুজেঠুর সঙ্গে গান করতে যাই। খুব, খুব মজা হয়।’’ ৮ মাস ধরে আশ্রমে গান শিখতে আসছে সঞ্চিতা মণ্ডল। তার কথায়, ‘‘গান তো শেখা হয়। সঙ্গে গানের শেষে মুড়ি-শিঙাড়া। সেটাও কম লোভনীয় নয়।’’
সকলে যখন বাবু ফকিরের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, তিনি তখন বলছেন, ‘‘সাধু, একটা গান শুনবা?’’ বলেই দোতারায় আঙুল চালিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে ধরলেন, ‘যে গঠিল এ রংমহল না জানি তার রূপটি কেমন, সিরাজ সাঁই কয় নাই রে লালন তার তুলনা…’।