অবশেষে মুম্বইতে মেট্রো রেল এল। ভারসোভা থেকে ঘাটকোপার পর্যন্ত, আবার সেখান থেকে ফেরত ভারসোভা—এই যাত্রাটি শুরু হয় গত বছর জুন মাসে। দেখতে দেখতে এক বছর হতে চলল। ভারতবর্ষের প্রথম রেল ছুটেছিল বম্বে থেকে থানে। মেট্রো রেলের ক্ষেত্রে মুম্বই তৃতীয়। জালের মতো বিস্তৃত ফ্লাইওভারের মুম্বই শহরে মেট্রো রেল সত্যিই কি যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনও আশাপ্রদ সংযোজন মুম্বইকরদের জন্য?
দিল্লি মেট্রোর আদলে তৈরি এই মুম্বই মেট্রো। রেলের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রিলায়্যান্স কোম্পানির পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের এত বড় পদক্ষেপ। তিন পর্যায়ের এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রথম পর্যায়ের কাজের মধ্যে চারকপ থেকে মানকুর্দ এবং কোলাবা থেকে সীপত্জ যোগাযোগের কাজ এখনও বাকি। কোলাবা-সীপত্জ মেট্রো মাটির তলায় সুড়ঙ্গ দিয়ে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে চারকপ থেকে দহিসার, মুলুন্দ থেকে ঘাটকোপার যুক্ত করা হবে। তৃতীয় পর্যায়ে আন্ধেরি পূর্বর সঙ্গে দহিসার পূর্ব, হুতাত্মা চক অর্থাত্ ফাউন্টেন থেকে ঘাটকোপার যুক্ত করা হবে। আরও যোগ করা হবে সিউড়ি থেকে প্রভাদেবী। স্টেশনগুলিতে সর্বমোট ৯৫টি চলন্ত সিঁড়ি, ৪৫টি লিফ্ট, ২০০টি সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকবে। আপনা-আপনি যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকবে। বর্তমানে রয়েছে মোট এক হাজার কর্মী। তার মধ্যে দু’জন মহিলা চালক।
কোচগুলি বিশেষ ধরনের ইস্পাতে তৈরি। দৈর্ঘ্যে ছোট এই ট্রেনগুলির একটি কোচে পনেরোশ’ যাত্রী ধরে। একটি কামরা মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যে কামরাটি লিফ্টের কাছে দাঁড়াবে সেই কামরাটিতে পঙ্গুদের জন্য হুইলচেয়ার সমেত ট্রেনে ওঠার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। কামরাগুলিতে শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। সাতশোটি সিসিটিভি ক্যামেরা দিনরাত যাত্রীদের গতিবিধির ওপর নজর রাখবে। তার প্রমাণও মিলেছে। সুরেখা কাম্বলে গিয়েছিলেন ভারসোভা থেকে ডি এন নগর। স্টেশনেই অপেক্ষা করছিলেন বান্ধবীর জন্য, আর নজর রাখছিলেন বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের ওপর। কিছুক্ষণ বাদে উর্দি-পরা সুরক্ষা কর্মী এসে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে বেঞ্চে বসে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেন। সঙ্গে এও জানিয়ে দিলেন সিসিটিভি ক্যামেরায় তাকে দেখা গেছে, তাই বড় কর্তার নির্দেশে তাকে প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করতে এসেছে। অর্থাত্ মুম্বই মেট্রোতে সুরক্ষা কর্মীরা শুধুমাত্র আতঙ্কবাদী মোকাবিলার জন্যই নয়, যাত্রীর সুরক্ষা এবং আত্মহত্যা করতে আসা ‘যাত্রীদের’ বাঁচাতেও তারা সমান সতর্ক। রেল স্টেশন পরিষ্কার রাখার প্রয়াস ও নজরদারি বেশ জোর কদমে চলে।
ছোটবেলায় পড়তাম যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি ও সুযোগ বাড়ে। মুম্বইতে যে মেট্রো রেল আসবে, সেটা এমন কী! মেট্রো রেল আসাতে সুবিধা অবশ্যই হয়েছে। পশ্চিম মুম্বইয়ের সঙ্গে মধ্য মুম্বইয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার মাধ্যমে যোগাযোগের চাপটা অনেক কমে গিয়েছে। প্রতিদিন অফিসযাত্রার সময় যানবাহনের যে ভিড়টা হত আন্ধেরি থেকে চাকালার পথে, তা অনেকটাই কমে এসেছে। যারা অটো ট্যাক্সিতে যাতায়াত করতেন, তারা এখন মেট্রো রেলের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অনেক তাড়াতাড়ি, অনেক বেশি আরামের যাত্রা। উপরন্তু দূষণমুক্ত। তবে শুরুতে ভাড়া যা ছিল এখন একটু বেড়েছে। সে সময় যাত্রী-সংখ্যা কমে গিয়েছিল, কিন্তু মেট্রোর সুবিধার জন্য আবার যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
মুম্বই মেট্রো রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজনে যোগাযোগের সাধন। কিন্তু সত্যিই কি কলকাতাবাসীর মন জয় করতে পেরেছে এই মুম্বই মেট্রো?
বাঙালির কাছে মেট্রো রেল নতুন নয়। কলকাতার মেট্রো আগে ছুটত টালিগঞ্জ থেকে এসপ্ল্যানেড। এখন আরও বিস্তৃত হয়ে গড়িয়া থেকে দমদম ছুটছে। ভবিষ্যতে এর আরও বিস্তার হবে, তারই কাজ চলছে। মুম্বইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে কলকাতা মেট্রো রেলের এক একটি কলেবর দৈর্ঘ্যে যথেষ্ট বড়। বহু ট্রেনে শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়েছে।
দিল্লি মেট্রো
কলকাতার সঙ্গে তুলনা করলে মুম্বই মেট্রো রেলের দীনতাই বাঙালি চোখে বেশি করে পড়বে। এ দীনতা অভাবের নয়। এ দীনতা কোনও দিনও শেষ-না-হওয়া বাণিজ্যিক আকাঙ্ক্ষার ক্রমাগত বর্ধিত লালসা, পুঁজিবাদী চিন্তাভাবনার কাঙালিপনা। অর্থাত্ যে পরিমাণ মূলধন মেট্রো রেলে খরচ হয়েছে তা রাতারাতি ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা এবং লাভের মুখ দেখার পরিকল্পনা। মুম্বই মেট্রো রেলের টিকিট বা ভাড়ার ব্যবস্থা নিয়ে যাত্রীদের যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। লোকাল ট্রেনের টিকিটে যেমন এক দিনে একাধিক বার যাতায়াত করা যায়, মেট্রো রেলে তা হয় না। একমাসের পাস নিলে কত বার চড়া হবে তা গুনে নিয়ে ভাড়া ধার্য করা হয়। যদি কোনও কারণে এক দিনে দু’বার যাতায়াত করতে হয় তা হলে একটা দিনের ভাড়া নষ্ট হয়ে যায়।
দীপক সালুঙ্কে অসুবিধার কথা সবিস্তার জানালেন। প্রথম মাসে তিনি টিকিট কেটে ছিলেন সাড়ে আটশো টাকার। যার মধ্যে পঞ্চাশ টাকা পাসটা তৈরির জন্য। এখন এই আটশো টাকার টিকিটে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তিনি ষাটবার যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু টিকিট কাটার সময় বলা হয়েছিল ষাট দিন চলবে। অর্থাত্ ষাট বারের ট্রিপে যদি কেউ মনে করেন দু’মাসের টিকিট কাটা হয়েছে, তা হলে ভুল হবে। কারণ ওই পাসটিতে ব্যালান্স থাকলেও নির্দিষ্ট তারিখে সেটি অকেজো হয়ে যাবে। তার এই ভুলের জন্য ভাঙা মাসে দু’শো টাকার টিকিট আবার কাটতে হয়েছিল দীপকবাবুকে। যারা নিত্যযাত্রী তাদের প্রতিদিন টিকিট কাটার জন্য লাইনের ভিড়ে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই যাত্রীরা এ ব্যবস্থা মেনে নিয়েই যাত্রা করছেন। এ ছাড়া আরও অসুবিধা রয়েছে। যেহেতু বর্তমান মেট্রো রেলটি পশ্চিমের সঙ্গে মধ্য মুম্বই যুক্ত করছে, সেই হেতু অনেকেরই দিক ভুল হচ্ছে। আর দিক ভুল হওয়ার জন্য যদি ভুলবশত টিকিট কাটা হয়ে যায় তা হলে সেই টাকাটা ঠিক টিকিটের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করা হচ্ছে না। মানুষকে নতুন টিকিট অথবা পাশ নিতে হচ্ছে।
মুম্বই মেট্রোর প্রত্যেকটাই অংশই যেন পক্ষপাতী সুদ কষা অঙ্কের হিসাব মিলিয়ে তৈরি, প্রত্যেকটা অংশই নিজেদের বিক্রি করার জন্য—ট্রেনের কলেবর থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম যেন বিজ্ঞাপনে মুখটি ঢাকা। পুঁজিবাদী শহরটায় মেট্রো রেলের এক একজন যাত্রী এক একজন উপভোক্তা। ট্রেনের বাইরের দিকের গায়ে বিভিন্ন কোম্পানির বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন পুরো ট্রেনটাকেই ঢেকে ফেলেছে। ভেতরেও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন। এতেই শেষ নয়। প্রত্যেকটি প্ল্যাটফর্মে বিশেষ একটি খাবারের কোম্পানিকে কিছুটা অংশ ভাড়া দেওয়া হয়েছে তাদের খাবারের স্টল লাগাবার জন্য। স্টলগুলি বেশ আধুনিক ধরনের। লোকাল ট্রেনের স্টেশনের ধারের মামুলি কোনও বড়া পাও বিক্রেতার মতো নয়। আইসক্রিম ও জলখাবারের পাশ্চাত্য আদলের ঝকঝকে তকতকে দোকান।
কলকাতা মেট্রো রেলে চড়লে পুরো শহরটার একটা চালচিত্র পাওয়া যায়। বোঝা যায় শহরটা এবং সেই সঙ্গে শহরের বাসিন্দারা কতটা সংস্কৃতিমনষ্ক এবং আবেগপ্রবণ। প্রত্যেক স্টেশনে তার ছাপ রয়েছে। স্টেশন রবীন্দ্র সদনের দেওয়ালের গায়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা রচনা, তাঁর আঁকা ছবি মনে করিয়ে দেয় যে ট্রেনটা কোন স্টেশনে এল। পার্কস্ট্রিট স্টেশনে মাদার টেরিজার ছবি ও ময়দানে গোষ্ঠ পালের ছবি বুঝিয়ে দেয় জায়গাগুলির বিশেষত্ব। শুধু যে কোনও বিশেষ ব্যক্তিত্বের ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হয়নি, পথিকৃত্গুলো বিভিন্ন শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানেই তার সৌন্দর্য ও বিশেষত্ব। কোনও কোনও স্টেশনে রয়েছে বাংলার বিখ্যাত পোড়ামাটির কাজ।
মুম্বই মেট্রো স্টেশনে কোথায় এ সমস্ত কাজ? কোথায় সেই বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার খোরাক? কলকাতার আপামর জনতা যে ভাবে শিল্পকে গ্রহণ করে, সে ভাবে বোধহয় আর কোনও শহরের মানুষ করে না। মুম্বইকরের কাছে এই শিল্পকর্মের রস গ্রহণ করার কোনও সময় নেই। মুম্বইকর থামতে জানে না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত পয়সা রোজগারের। তাই তাদের প্রতিযোগিতা সময়ের সঙ্গে।
কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন স্টেশনগুলির নাম নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কলকাতার মানুষগুলো পরিচিত জায়গাগুলি নতুন নামে চিনতে চায়নি। কিন্তু স্মরণীয় মানুষের নামে জায়গার নাম রাখার নজির বোধহয় নতুন নয়। এ উদাহরণ খাস মুম্বই শহরেই অনেক আছে। যেমন দক্ষিণ মুম্বইয়ের যে এলাকাটি ভেন্ডি বাজার নামে পরিচিত, সেই এলাকাটির বাসস্টপের নাম বিজয় বল্লভ চক। হাজিআলি এলাকাটির বাসস্টপের নাম বত্সলাবাই চক। তারদেও এলাকাটির নাম বসন্ত রাও নায়েক চক। তাই মাস্টারদা সূর্য সেন বা কবি সুভাষ, গীতাঞ্জলি নামের স্টেশনগুলি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও তা সাময়িক। আর যদি মনে করা হয় খেয়ালি মানুষের হঠাত্ পেয়ে বসা খেয়ালে এই নামকরণ, তা হলে ভারতের অন্যান্য শহরগুলির দিকে একবার ফিরে তাকানো দরকার। মুম্বই মেট্রো যাত্রীদের আশার আলো দেখিয়েছে ঠিকই কিন্তু চোখ কান খোলা না রেখে টিকিট কাটলে গাঁট কাটা চোরের মতো পয়সা হাপিস করার পন্থাও তৈরি করে রেখেছে।