সংস্কারের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো রাজনীতির সঙ্গে আপস করবে না কেন্দ্র। যে কোনও মূল্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে সংস্কারের রথ। পারলে আটকাও! বিমায় বিদেশি লগ্নি এবং কয়লা খনি নিলাম নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারি করে বুধবার বিরোধীদের দিকে যেন এই চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিল মোদী-সরকার।
প্রত্যাশা মতোই বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ২৬ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশে নিয়ে যেতে এ দিন অর্ডিন্যান্স জারি করল কেন্দ্র। একই পথে হাঁটল নতুন করে কয়লা খনি বণ্টনের জন্য। চিকিৎসা-যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে ১০০% বিদেশি লগ্নিকে ছাড়পত্র দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিল তারা। যাকে সংস্কারের ছোট কিন্তু ঝোড়ো ইনিংস বলে মনে করছেন অনেকে।
বিরোধীদের বাধায় শত চেষ্টাতেও শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভায় পাশ করানো যায়নি বিমা ও কয়লা বিল। তাই সেই অধিবেশন শেষের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ দিন ওই দুই ক্ষেত্রে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে কেন্দ্র। কোনও বিলে অর্ডিন্যান্স জারির অর্থ সংসদে তা পাশ হওয়ার আগেই চালু করা। যদিও ছ’মাসের মধ্যে তা সংসদে পাশ করানো বাধ্যতামূলক।
বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, সরকার গড়ার ছ’মাস পরেও সংস্কারের চাকায় গতি না-ফেরায় শিল্পমহল যে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে তা বিলক্ষণ জানেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই কারণেই এ দিন শিল্পমহলকে তাঁরা অন্তত বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার অটল। অন্তত সে বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক বাধার সামনে মাথা নোয়াবে না তারা।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএমের মতো বিরোধী দলগুলির অবশ্য প্রশ্ন, এই অর্ডিন্যান্সের সিদ্ধান্ত কতখানি গণতান্ত্রিক? কিন্তু তার উত্তরে কেন্দ্রের পাল্টা চ্যালেঞ্জ, পদক্ষেপ করা হয়েছে সংবিধানের মধ্যে থেকেই। পারলে আটকে দেখাক! জেটলির ইঙ্গিত, অর্ডিন্যান্স হয়েছে। রাজ্যসভায় ফের বাধা এলে যৌথ অধিবেশন ডেকে বিল পাশ করানো হবে। তাঁর যুক্তি, “সংস্কার অপেক্ষা করতে পারে না।”
আসলে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক লড়াইকে এ বার বিরোধীদের কোর্টে নিয়ে যেতে চাইছেন মোদী-জেটলি জুটি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাতিল হওয়া কয়লা খনি ফের বণ্টনের জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করে ৩১ মার্চের মধ্যে নিলাম সেরে ফেলা হবে। তাতে বিদ্যুৎ, ইস্পাতের মতো শিল্পে কয়লার অভাব মিটবে। নিলামের অর্থ পাবে রাজ্যগুলি। সবথেকে উপকৃত হবে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলি। জেটলির বক্তব্য, “কে নিজের রাজ্যের রাজস্ব ক্ষতির পক্ষে সায় দেয়, এ বার তা দেখা যাবে!” চার দিন আগে ফিকি-র সভায় সংস্কারের কাজে বাধা দেওয়ার জন্য তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন জেটলি। এ দিনও তাঁর ইঙ্গিত, তৃণমূল, সিপিএম, জেডি (ইউ)-র মতো দলগুলি সংস্কারে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের রাজ্যেরও ক্ষতি করছে বলে প্রচারে যাবে বিজেপি।
প্রত্যাশিত ভাবেই অর্ডিন্যান্সের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিমায় পুঁজির অভাব মিটবে। নয়া লগ্নির পরিবেশ গড়ে তুলতেও তা সহায়ক হবে।” দাবি, “এতে সরকারের নীতিতে লগ্নিকারীদের আস্থা বাড়বে।”
লোকসভায় একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় সরকারের তা নেই। যার ফায়দা তুলে বিভিন্ন বিল আটকে দিচ্ছে বিরোধী দলগুলি। এই পরিস্থিতিতে কত দিন অর্ডিন্যান্স করে এগোতে পারবে কেন্দ্র?
মোদী-সরকারের বক্তব্য, জম্মু-কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ভাল ফল করেছে। ২০১৫ ও ২০১৬-তে আরও কিছু বিধানসভা ভোট আছে। সেখানে ভাল করলে আগামী দিনে রাজ্যসভায় বিজেপির প্রতিনিধিত্ব বাড়বে।
মনমোহন-জমানার শেষ দিকে সংসদে বাধা পেয়ে অর্ডিন্যান্স করেই চালু হয়েছিল খাদ্য সুরক্ষা আইন। কিন্তু আজ সেই কংগ্রেসই অর্ডিন্যান্স জারি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দিগ্বিজয় সিংহের অভিযোগ, “যখন সংসদ চলছে না, সে সময় জরুরি পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে সংবিধানে অর্ডিন্যান্সের পথ রাখা হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই ওই পথ নিচ্ছে মোদী-সরকার।” তাঁর প্রশ্ন, বিমায় বিদেশি লগ্নির জন্য তাড়াহুড়ো কীসের?” জেটলির জবাব, “অনেক দেরি হয়েছে। সে জন্যই তাড়াহুড়ো।”
তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েনের বক্তব্য, “এই সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। সরকার বুলডোজার চালাচ্ছে।” সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন, যাতে তিনি অর্ডিন্যান্সে সই না-করেন। তাঁর অভিযোগ, “ইন্দিরা-জমানার জরুরি অবস্থা ফিরছে।” কিন্তু মোদী সরকারের বক্তব্য, সাম্প্রতিক অতীতেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্ডিন্যান্স জারির ১১টি দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বিরোধীদের যুক্তি, বিমা-বিল সংসদে পেশ হয়েছে। সিলেক্ট কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। তারপরে এতে অর্ডিন্যান্স জারি হতে পারে না। এ ক্ষেত্রেও সরকারের পাল্টা যুক্তি, সেবি আইন সংশোধনের সময়ও বিল পাশের পরেই অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল। তা ছাড়া, বিমায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ৪৯% করা হয়েছে সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট মেনেই।