উষ্ণ অভ্যর্থনা। রবিবার নয়াদিল্লিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এমনই এক আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি ফেসবুকে লাইক করেছেন স্বয়ং ফেসবুকের জনক মার্ক জুকারবার্গ। ছবি: এএফপি
দিনভর কূটনীতি অনেক হল, সন্ধেটা হোক আলাদা।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ‘বাড়ি’তে তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় এই কথাই যেন বারবার বোঝাতে চাইলেন বারাক ওবামা। কখনও শরীরী ভাষায়, কখনও মনকাড়া ছোট্ট বক্তৃতায়।
যে বক্তৃতা শুনতে শুনতে রাইসিনা পাহাড়ের সেরিমনিয়াল হলের আপাত গুরুগম্ভীর জমায়েতে হাসির গুঞ্জন উঠল বারবার। যে বক্তৃতায় ওবামা অকপটে বলে ফেললেন, “আজ ভেবেছিলাম মোদী-কুর্তা পরব।”
এই এক বার শুধু নয়, ওবামার বক্তৃতায় ফিরে ফিরে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই মোদীর জীবনযুদ্ধের কথা বলছেন, এই বলছেন তাঁর কাজপাগল স্বভাবের কথা, তো এই কুর্নিশ জানাচ্ছেন তাঁর ফ্যাশন-সচেতনতাকে।
যেমন জানালেন, তাঁর দেশের কোনও এক কাগজে এক বার হেডলাইন বেরিয়েছিল, ‘মিশেল ওবামাকে বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে নতুন ফ্যাশন আইকন কে?’ আর সে কথা বলতে গিয়েই মোদী-কুর্তার অবতারণা। শুনে স্বয়ং মোদীর মুখেও দেখা দিল লাজুক হাসি। টেবিলের উল্টোদিকে তখন মুচকি হাসছেন সনিয়া গাঁধী।
ওবামা বললেন, “শুধু জানতাম না উনি (মোদী) এক বার কুমিরের সঙ্গে লড়েছিলেন। কাজেই উনি কড়া ধাতের মানুষ। আর হ্যাঁ, ওঁর একটা স্টাইল আছে। উনি কী ভাবে দিনরাত কাজ করেন, সেটা শুনেছিলাম। কিন্তু আজ শুনলাম, গত রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একটু খারাপ লাগল। আমি যে ঘণ্টাপাঁচেক দিব্যি ঘুমিয়েছি!” পানপাত্র তুলে ধরে নৈশভোজের ‘টোস্ট’ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বললেন, ভারত ও আমেরিকার ‘দোস্তি’ দীর্ঘজীবী হোক।
অতিথি-তালিকায় চোখ বোলালে ‘চাঁদের হাট’ কথাটাও ফিকে শোনাবে। এক দিকে সস্ত্রীক উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন, সনিয়া গাঁধী, লালকৃষ্ণ আডবাণী। অন্য দিকে রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, স্মৃতি ইরানি-সহ একঝাঁক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ছিলেন মুকেশ অম্বানী, অনিল অম্বানী, রতন টাটা, সাইরাস মিস্ত্রি, গৌতম আদানির মতো প্রথম সারির শিল্পপতিরা। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো জন বাছাই করা অতিথি।
আজ ব্ল্যাক স্যুটের সঙ্গে তাঁর ‘সিগনেচার’ আকাশি টাই পরেছিলেন ওবামা। মিশেল পরেছিলেন নেভি ব্লু ফুলকাটা প্রিন্টের পোশাক। সাউথ হলে প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠকের পর একে একে অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন ওবামা দম্পতি। সেই সময়েই আর এক গভীর মুহূর্ত তৈরি হল, যখন ওবামার সামনে এলেন মনমোহন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে দূর থেকে দেখে হাতটা বাড়িয়েই রেখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মনমোহন সামনে আসতেই উচ্ছ্বসিত করমর্দন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর হাত ধরে কথা বললেন ওবামা। মনমোহনের স্ত্রী গুরশরণ কৌরকে জড়িয়ে চুমু খেলেন মিশেল। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির পথে আজ ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। সেই চুক্তির ভিত রাখতে মনমোহন যে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন তা ওয়াশিংটনের অজানা নয়। অতীত সেই স্মৃতিই ফের মূর্ত হয়ে ওঠে রাইসিনায়।
অতীতের আর এক স্মৃতিও এ দিন তুলে আনেন ওবামা। নভেম্বর, ২০১০। সে বার ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ নেমেছিল মুম্বইয়ে। ওবামার কথায়, “ভারতের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। তবে এ জন্যও ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, এ বার আর আমাকে নাচতে হল না।” আগের বার যখন এসেছিলেন, তখন ছিল দেওয়ালি। মুম্বইয়ের শিশুদের এক অনুষ্ঠানে নাচতে হয়েছিল ওবামা দম্পতিকে। সহাস্য প্রেসিডেন্ট যোগ করলেন, “পরের দিন একটা ভারতীয় কাগজ লিখল, ‘প্রেসিডেন্ট ওবামা এলেন’। আর একটা কাগজ লিখল, ‘মিশেল রকস ইন্ডিয়া!’
ওবামার সম্মানে আজ রাষ্ট্রপতি ভবনে ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানও হয়েছে। সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে বেজেছে বাংলা ও হিন্দি গানের সুর, ওবামার প্রচারে বহু ব্যবহৃত গান ‘ইয়েস উই ক্যান’। কিন্তু অনেকেই মানছেন, অনুষ্ঠান সত্যি-সত্যিই জমে গেল রাত ৯টা ১০ নাগাদ। যখন ওবামা তাঁর বক্তৃতাটি দিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে তাঁর স্বাগত বক্তৃতায় প্রণববাবু জানালেন, ওবামার এ বার সফর ঐতিহাসিক হয়ে রইল তিনটি রেকর্ডের সৌজন্যে। কী কী রেকর্ড? রাষ্ট্রপতির কথায়, “আপনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে উপস্থিত থাকবেন। এর আগে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টই নিজের মেয়াদে দু’বার ভারত সফরে আসেননি। এবং চার মাসের ব্যবধানে দু’বার শীর্ষ বৈঠকও এই প্রথম হল।”
‘ঐতিহাসিক’ এই সফরই কি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার শেষ ভারত সফর? কারও কারও মতে, সেই সম্ভাবনার কথায় মাথায় রেখেই আজ সন্ধেয় কূটনীতি সরিয়ে ভারতের মনটাকে ছুঁতে চাইলেন ওবামা। আর সেই বার্তা দিতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বেছে নিলেন খোদ মোদীকে।
তবে নৈশভোজের শেষে মুখে মুখে ফিরল একটাই কথা। সত্যি, মোদী কুর্তা পরলে কেমন দেখাত ওবামাকে!
রাষ্ট্রপতি ভবনে পিটিআইয়ের তোলা ছবি।