শিবরাজের ইস্তফার দাবিতে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
হাইকোর্ট আপাতত হাত তুলে দিয়েছে। সিবিআই তদন্ত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মন বুঝে পদক্ষেপ করবে। এখন নজর কাল সুপ্রিম কোর্টের দিকে। তার আগে আজ সাহসী মুখ করে দিল্লি এলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান।
এমন একটি সময়, যখন ব্যপম কেলেঙ্কারি নিয়ে ভোপাল থেকে দিল্লি উত্তাল। এমন একটি সময়, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদেশে। আর সেই সময়ই ‘বন্ধু’ নেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করলেন শিবরাজ। সাহসী মুখ করে জানালেন, ইস্তফা দেবেন না। ব্যপম কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত নিয়ে হাইকোর্ট আপাতত কোনও রায় না দিলেও সুপ্রিম কোর্টেও একই দাবি জানাবেন তিনি। সুষমার সঙ্গে বৈঠকের পর বললেন, নিহত সাংবাদিক অক্ষয় সিংহের বাড়িতেও যাবেন তিনি।
শিবরাজ এসেছেন অবশ্য অগস্টে ভোপালে আন্তর্জাতিক হিন্দি সম্মেলনের প্রস্তুতি-বৈঠকের অছিলায়। সেই বৈঠক সেরে আজই ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও শিবরাজ ফেরেননি। রয়ে গিয়েছেন দিল্লিতে। সচরাচর যা তিনি করেন না। আসলে দিল্লিতে এসে জল মাপতে চাইছেন তিনি। আজ অনন্ত কুমার, নরেন্দ্র তোমর ও বিজেপির জাতীয় সহসভাপতি বিনয় সহস্রবুদ্ধে ছাড়া দলের আর কোনও বড় নেতার সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর। তবে যে কারণেই হোক ভাইয়াজি জোশী, কৃষ্ণ গোপালের মতো আরএসএসের শীর্ষস্থানীয় কয়েক জন নেতা এই মুহূর্তে দিল্লিতে। এবং এটাও ঘটনা, ব্যপম কেলেঙ্কারিতে সুরেশ সোনি-সহ বেশ কয়েক জন আরএসএস নেতার নামও জড়িয়েছে। শিবরাজ-ঘনিষ্ঠরা বলতে শুরু করেছেন, ডুবলে অন্যদের নিয়েই ডুববেন মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে শিবরাজের থেকে যাওয়া ও সঙ্ঘের নেতাদের দিল্লিতে থাকাটাকে নিছক সমাপতন বলে মনে করছে না বিরোধী শিবির।
শিবরাজ জানেন, ব্যপমের তদন্ত যদি এক বার সিবিআইয়ের হাতে চলে যায়, তা হলে দলের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী মোদী চাইলে তাঁকে অনেক বেশি বেগ দিতে পারেন। তদন্ত যতই নিরপেক্ষ হোক, শাসক দলের হাতে সিবিআইয়ের অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। অতীতের মতো এ বারেও হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের আর্জি খারিজ করে দিলে অবশ্য সেই সঙ্কটের মুখে পড়তে হবে না।
সুপ্রিম কোর্টে কাল সিবিআই তদন্তের চারটি আর্জি শুনবে। একটি আবেদন কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের। বাকিরা হলেন আশিস চতুর্বেদী, আনন্দ রাই ও প্রশান্ত পাণ্ডে। ব্যপম কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন এঁরা। এঁদের আর্জি শীর্ষ আদালতে শুনানির এক দিন আগে শিবরাজ আজ দিল্লিতে দাঁড়িয়ে ফলাও করে বললেন, ‘‘কংগ্রেস আমল থেকে চলা দুর্নীতির রাশ টানতে আমিই ব্যবস্থা নিয়েছি। ঘটনা সামনে আসতেই তার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। এখন সুপ্রিম কোর্টেও সিবিআই তদন্তের অনুরোধ করব।’’
আগে তবে কেন আপত্তি করেছিলেন সিবিআই তদন্তে?
শিবরাজ যুক্তি দেন, ‘‘দুটোই সত্য। এ পর্যন্ত সব আদালতই বলেছে, তদন্ত ঠিক হচ্ছে। তাই সিবিআই তদন্ত চাইনি। কিন্তু গত ক’দিনে পরিস্থিতি এমন মোড় নিয়েছে, তাতে সংশয় তৈরি হয়েছে। তাই এখন সিবিআই তদন্ত চাইছি।’’
কংগ্রেসের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে একটি নয়, দু’দুটি পৃথক সিবিআই তদন্ত হওয়া দরকার। এক, ব্যপমের মাধ্যমে ভর্তি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারির তদন্ত। দুই, একের পর এক রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত। যা ব্যপম কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা বলেই অভিযোগ কংগ্রেস ও বিভিন্ন মহলের। হত ক’দিনে পরপর কয়েক জনের মৃত্যুর ঘটনা এই সন্দেহ বাড়িয়েছে। কংগ্রেসের দাবি, ব্যপম ধামাচাপ দিতে এ পর্যন্ত ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। খাদ্যে বিষক্রিয়ার রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে আজও। গরমিল সামনে আসছে পুরনো মৃত্যুর ঘটনায়। যেমন, নম্রতা দামোরের মৃত্যুকে এত দিন আত্মহত্যা বলে দাবি করে এসেছে পুলিশ। কিন্তু চিকিৎসকই এখন বলছেন, এটি হত্যা। অভিযোগ রয়েছে রাজ্যপাল রাম নরেশ যাদবের বিরুদ্ধেও। অনেক মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকেও আড়াল করা হচ্ছে। এফআইআর-এ মন্ত্রীর নাম লেখা হয়নি, তাঁর অভিযুক্ত স্ত্রীকে স্রেফ ‘মন্ত্রানী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কংগ্রেসের প্রশ্ন, এই যদি তদন্তের অবস্থা হয়, তা হলে শিবরাজ কোন সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করছেন? এখনই তো তাঁর সরে যাওয়া উচিত।
মোদী বা অমিত শাহেরও মাথাব্যথা কম নয় শিবরাজকে নিয়ে। ২১ জুলাই সংসদ বসছে। তার আগে ব্যপম প্রসঙ্গ বাকি বিরোধীদের এককাট্টা করে তুলছে। কংগ্রেসের সঙ্গে বাকি বিরোধীরা জোট বেঁধে সংসদ অচল করে রাখলে সংস্কারের বিলগুলি সব আটকে থাকবে।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছেন, সংসদ শুরুর আগেই ২০ জুলাই ৬ বাম দল বিজেপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে। বামফ্রন্টের চার দল ছাড়াও তাঁদের সঙ্গে এসইউসি এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশন রয়েছে। ইয়েচুরি বলেন, ‘‘ইউপিএ সরকার প্রথম পাঁচ বছর সরকার চালানোর পরে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। আর নরেন্দ্র মোদী দুর্নীতি মুক্ত সরকার উপহার দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে এক বছরের মধ্যেই নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।’’ সুষমা স্বরাজ, বসুন্ধরা রাজে, স্মৃতি ইরানি, শিবরাজ সিংহ চৌহান এবং পঙ্কজা মুন্ডের ইস্তফা দাবি করে ইয়েচুরি বলেন, ‘‘আমরা চাই, সংসদে সমস্ত বিরোধী দল এক হয়ে বিজেপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুক।’’ ব্যপম কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্ত হোক। কারণ, এই কেলেঙ্কারি অপরাধ এবং দুর্নীতির মিশেল।’’
পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে শিবরাজের সামনে এখন এসপার-ওসপার লড়াই বলেই মনে করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। অন্য বিজেপি নেতারাও মানছেন, দলে একটি অংশ এখন শিবরাজের প্রতি খড়্গহস্ত হচ্ছেন। অরুণ জেটলি ব্যপম নিয়ে প্রথম বার মুখ খুলেই সিবিআই তদন্তের ইঙ্গিত দিয়ে বসে আছেন। ঠারেঠোরে শিবরাজকে বিঁধছেন উমা ভারতী। শিবরাজের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবুলাল গৌড়ও এখন বিদ্রোহী। শিবরাজ এ অবস্থায় রদবদল করতে চেয়েছিলেন মন্ত্রিসভায়। কিন্তু এখন সেটিও করতে পারছেন না। ফলে আজ সাহসী মুখ করে ইস্তফা না দেওয়ার কথা বললেও যদি তাঁর গদি টলমল হয়, তা হলে তিনিও ঘুরে দাঁড়াবেন— এমন আশঙ্কাও রয়েছে বিজেপি শিবিরে। শিবরাজ-ঘনিষ্ঠ এক নেতা আজ স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজে ডুবলে সকলকে নিয়ে ডুববেন। যদি তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তা হলে সকলকে নিয়েই দাঁড়াবেন।’’
অসুস্থ আইনজীবী
হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আইনজীবী আদর্শ মুন্নি ত্রিবেদী। একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ভর্তিতে কারচুপি নিয়ে জনস্বার্থ মামলার শুনানি ছিল বুধবার। ত্রিবেদী ওই মামলার আবেদনকারী আইনজীবী। এ দিন আদালতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু গত কাল নিজের অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বমি ও সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। পরিবারের দাবি, তাঁর খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল। ‘‘গত কাল বাবার অফিসের কেউ ডালের বড়া রেখে গিয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন বাড়িরই কেউ দিয়ে গিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে খাবার পাঠানো হয়। ফলে সন্দেহজনক কিছু দেখতে পাননি,’’ দাবি করেন আইনজীবীর বড় ছেলে আশিস। এ হেন দাবির কারণ হিসেবে আশিসের বক্তব্য, এক সময় ব্যপম মামলায় রাজ্য সরকারের হয়ে হাইকোর্টের কাছে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছিলেন ত্রিবেদী। তার জেরেই হয়তো এই ঘটনা।