গাড়ি চালিয়ে হাথরসের পথে প্রিয়ঙ্কা, পাশে দাদা রাহুল— ফাইল চিত্র।
গাড়ির চালকের আসনে তিনি। স্টিয়ারিংয়ে অভ্যস্ত হাত। অনায়াস দক্ষতায় বদলে যাচ্ছে গিয়ার। চোখের দৃষ্টি উইন্ডস্ক্রিন পেরিয়ে সামনে। মাঝে মধ্যে পাশের আসনে বসা দাদার সঙ্গে কথা বলছেন অনুচ্চ স্বরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে গেল তাঁর ‘রূপ’। হাথরসগামী কংগ্রেস নেতাদের ঠেকাতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তৈরি ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়ে। দলীয় সহকর্মীর দিকে উদ্যত পুলিশের ফাইবারের লাঠি চেপে ধরলেন দু’হাতে। মাস্ক ঢাকা মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু দেখা গেল দু’চোখ। তাতে স্পষ্ট উষ্মা।
প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। হাথরস-কান্ডে শনিবার তাঁকে নতুন রূপে দেখল গোটা দেশ। সাক্ষী হল এমন অনেক প্রতীকী দৃশ্যের। তাঁর দিনভর ‘দৌড়’ মনে করিয়ে দিল ভারতীয় রাজনীতির অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্তকে। জন্ম দিল নতুন জল্পনার।
হাথরসের বুলগারহী গ্রামে নির্যাতিতার বাড়িতে প্রিয়ঙ্কাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন নিহত তরুণীর মা। যোগী আদিত্যনাথের সরকারের ভীতি প্রদর্শনের কথা সমস্বরে জানাতে শুরু করলেন দলিত পরিবারটির অন্য সদস্যরা। প্রিয়ঙ্কার মুখে তখন ন্যায়বিচারের ল়ডাইয়ে তাঁদের পাশে থাকার ভরসা। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্তের দাবি।
হাথরসে যাওয়ার পথে পুলিশি হামলা থেকে আগলাচ্ছেন কংগ্রেস কর্মীদের।
রাজনীতি? রাজনীতিই তো। যে রাজনীতির তুঙ্গ উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন তাঁর ঠাকুমা ইন্দিরা গাঁধী। গত লোকসভা ভোটের আগে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন প্রিয়ঙ্কা। শুরুতেই শিক্ষা হয়েছে তাঁর। পূর্ব-উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে লোকসভা ভোটে তাঁর ‘পারফরম্যান্স’ কার্যত শূন্য। মা সনিয়ার কেন্দ্র রায়বরেলী ছাড়া অন্য কোথাও জেতেনি কংগ্রেস। এমনকি, দাদা রাহুলও ‘পারিবারিক আসন’ অমেঠীতে হেরেছেন। সাড়ে চার দশক আগেকার মোরারজি দেশাই-চরণ সিংহ-জগজীবন রামের দ্বন্দ্বে দীর্ণ জনতা পার্টি আর সঙ্ঘের সমর্থনপুষ্ট নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির মোকাবিলা করা যে এক নয়, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা হারানোর পর তা আরও স্পষ্ট।
আরও পড়ুন: রামবিলাসকে দূরে রেখেই নীতীশের সঙ্গে সমঝোতা বিজেপির
বস্তুত, লোকসভা ভোটের পরেও কংগ্রেসের ‘ক্ষয়’ অব্যাহত। সেই সঙ্গে মাথা চাড়া দিয়েছে দলের অন্দরে নেতৃত্বের সঙ্কট। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ’৭৭-এ ভোট ভরাডুবির পর। সনিয়া এখনও দলের অন্তর্বর্তী সভানেত্রী। কিন্তু কংগ্রেসে‘চালকের’ আসন শূন্য। রাহুল দলের দায়িত্ব গ্রহণে গররাজি হওয়ার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে হাথরসের প্রিয়ঙ্কার মধ্যে‘আশার আলো’ দেখতে শুরু করেছেন কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের বড় অংশই।
অগস্টে কংগ্রেসের ২৩ জন নেতা দলে ‘স্থায়ী সময়ের সভাপতি’ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সনিয়াকে। এরপর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছ’মাসের মধ্যে এআইসিসি-র অধিবেশনে নয়া সভাপতি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে কি এ বার দলের স্টিয়ারিং হাতে নেবেন প্রিয়ঙ্কা? এসইউভি-র স্টিয়ারিং ধরে তাঁর হাথরস-সফর তেমনই জল্পনার জন্ম দিয়েছে।
পুলিশের লাঠির মুখেও প্রিয়ঙ্কা অবিচল— ফাইল চিত্র।
কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের একটি সূত্র অবশ্য বলছে, তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। দলের ‘ড্রাইভিং সিটে’ বসবেন রাহুলই। প্রিয়ঙ্কা থাকবেন সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায়। তাঁদের যৌথ নেতৃত্বে সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দলকে চাঙ্গা করার প্রচেষ্টা শুরু করবেন।কংগ্রেস নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশের মনেই কিন্তু শনিবারের ঘটনাক্রম নতুন প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছে— আগলে রাখা এবং ভরসা দেওয়ার বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ নিতে এ বার পিছপা হবেন না প্রিয়ঙ্কা।
এআইসিসি-র সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কংগ্রেসের সহকারী দলনেতা নেপাল মাহাতো রবিবার বলছিলেন, ‘‘প্রিয়ঙ্কাজি তো দলের ড্রাইভিং সিটেই রয়েছেন। রাহুলজি এবং প্রিয়ঙ্কাজি দু’জনেই রয়েছেন।’’ তবে কি সনিয়ার পর দলের সভানেত্রীর দায়িত্বে প্রিয়ঙ্কা? নেপাল বলেন, ‘‘রাহুলজি সভাপতি হলে খুবই ভাল হবে। কিন্তু উনি খুব আপত্তি করলে আমরা সকলে মিলে একবাক্যে প্রিয়ঙ্কাজির নামটাই বলব। তবে সভানেত্রী হোন বা না-হোন, প্রিয়ঙ্কাজি দলের ড্রাইভিং সিটেই রয়েছেন।’’
আরও পড়ুন: হাথরসে গোপন বৈঠক, অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়াতে একজোট উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা
প্রসঙ্গত, গত বছর লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের ‘দায়’ নিয়ে রাহুল সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরেও তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে প্রিয়ঙ্কার নামই উঠে এসেছিল। দলের একাংশ প্রকাশ্যেই তাঁকে নেতৃত্বে দেখতে চেয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয়ঙ্কা সবিনয়ে সেই আর্জি প্রত্যাখ্যান করেন।শনিবারের ঘটনাপর্ব কিন্তু কংগ্রেস নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশের মনে নতুন প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছে— বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ নিতে এ বার পিছপা না-ও হতে পারেন সনিয়া-তনয়া। এসইউভি-চালনার মতোই হাতে তুলে নিতে পারেন ১৩৫ বছরের দলের ‘স্টিয়ারিং’ও।