নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
উৎসবের আবহেও চাপা উৎকণ্ঠা। উৎসাহের স্রোতেও বুদবুদ উদ্বেগের। অযোধ্যার অলি-গলিতে কান পাতলে প্রশ্ন— বুধবার শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী
আসবেন তো?
উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনিক কর্তাদের দম ফেলার ফুরসত নেই। বুধবার নরেন্দ্র মোদী-সহ ভিভিআইপি-রা আসছেন ধরে নিয়েই মন্দির-শহর অযোধ্যাকে মুড়ে ফেলা হচ্ছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। রাস্তাঘাট জীবাণুমুক্ত করা থেকে আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর কাজ, প্রায় সারা। সোমবার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে অযোধ্যা এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। কিন্তু ‘যাঁর জন্য’ এত অপেক্ষা আর আয়োজন, সেই মোদী শেষমেশ রামমন্দিরের শিলান্যাসে আসবেন কি না, সেই জিজ্ঞাসা মুখে মুখে।
এ বিষয়ে এখনও একটি শব্দও খরচ করেননি প্রধানমন্ত্রী। সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি তাঁর দফতর। সেখান থেকে শুধু বলা হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি পাল্টায়নি। যা ছিল, তা-ই আছে। কিন্তু মুশকিল হল, ‘কী ছিল’, তা-ও তো কখনও ঘোষণা করা হয়নি! ফলে ধোঁয়াশা বহাল।
যাঁরা আসার আশায় বুক বাঁধছেন, তাঁদের যুক্তি, সারা বিশ্বের নজর কাড়া এমন অনুষ্ঠানের ছত্রিশ ঘণ্টা আগেও মোদী যখন না-আসার কথা বলেননি, উপরন্তু তাঁর নাম ছাপা হয়েছে আমন্ত্রণের কার্ডে, তার মানে তিনি আসছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে সংশয়ীদের সংখ্যাও গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় অনেকটা বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন অযোধ্যা ঘুরে এসে বলেছেন, ‘‘বুধবার দেশবাসীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীই মন্দিরের ভূমিপুজোর সূচনা করবেন।’’ তবুও সংশয় কাটেনি।
বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অমিত শাহ। তাই স্বেচ্ছায় নিভৃতবাসে চলে গিয়েছেন ওই দিন বৈঠকে হাজির থাকা বেশ কয়েক জন মন্ত্রী। প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রীও কি তাই করবেন? সে ক্ষেত্রে ৫ অগস্ট অযোধ্যার অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থাকা সম্ভব হবে না তাঁর পক্ষে। অনেকের আবার চিন্তা, দেশ যখন করোনা, চিনা আগ্রাসন, আর প্রবল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে এবং মন্ত্রিসভার দু’নম্বর শাহ করোনায় আক্রান্ত, তখন এত বড় ঝুঁকি মোদী নিজে নেবেন? তাতে সহজে রাজি হবেন তাঁর দফতরের আমলা আর প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা অফিসারেরা?
আরও পড়ুন: রামের নগরী যেন দুর্গের ঘেরাটোপে থাকা 'পীতাম্বরী' নববধূ
আরও পড়ুন: ‘আমি তো শুধু রামলালার পূজারী’! বললেন ‘বিষণ্ণ’ প্রধান পুরোহিত!
এই আশঙ্কা উস্কে দিয়ে এ দিন বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী বলেছেন, অমিত শাহ-সহ বেশ কিছু শীর্ষ বিজেপি নেতার করোনা সংক্রমণের খবর শোনার পরে প্রধানমন্ত্রীর অযোধ্যায় যাওয়া নিয়ে তিনিও উদ্বিগ্ন। তাই অযোধ্যায় গেলেও মোদীর থেকে দূরে থাকবেন বলে দাবি করেছেন তিনি। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহের কটাক্ষ, “৫ অগস্টের ওই মুহূর্ত যে অশুভ, তা আগেই বলেছিলেন শঙ্করাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে শিলান্যাসের দিন ঠিক হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সুবিধা অনুযায়ী। মোদী কি হিন্দু ধর্মের সনাতন বিশ্বাসের থেকেও বড়!”
রামমন্দিরের ভূমিপুজোর আমন্ত্রণপত্র।
দিগ্বিজয়ের বক্তব্য, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মোদী এবং যোগী দু’জনেরই উচিত নিভৃতবাসে যাওয়া। অশুভ মুহূর্তে এত বড় মাপের অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার কারণেই নাকি করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন রামলালার উপ-পুরোহিত থেকে শুরু করে একের পর এক বিজেপি নেতা! কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে আপাতত অনুষ্ঠান পিছোনোর কথাও প্রথম বললেন দিগ্বিজয়ই। যোগীর যদিও পাল্টা দাবি, ‘‘এমন শুভ কাজের আগে অশুভ বলা থেকে বিরত থাকুন সকলে। কংগ্রেস ইতিহাস ঘেঁটে দেখুক, কী ভাবে মন্দির তৈরিতে দেরি করিয়েছে তারা।’’
মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট সূত্রে খবর, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কমানোর চেষ্টা হচ্ছে অতিথির সংখ্যা। যাঁরা আমন্ত্রিত, তাঁদেরও খুব কম জন ঘেঁষতে পারবেন মোদীর কাছে। মঞ্চে তিনি ছাড়া থাকার কথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেল, সরসঙ্ঘ চালক মোহন ভাগবত এবং ট্রাস্টের কর্ণধার নৃত্যগোপাল দাসের। এমনিতেই এঁদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব রাখা হত। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা আরও বাড়তে পারে।
এই মন্দিরের সঙ্গে হিন্দুত্বের আবেগ এবং বিজেপির উত্থান কতখানি জড়িত, তা বিলক্ষণ জানেন মোদী। সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি এ-ও জানে যে, এখন থেকে মন্দির তৈরির কাজ শুরু হলে, তবে তিন-সাড়ে তিন বছর পরে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে তা শেষ হবে। তখন নির্বাচন ঘোষণার আগে ধূমধাম করে মন্দিরের উদ্বোধনে সম্ভব হবে ভোটের মুখে দেশ জুড়ে হিন্দুত্বের জিগির তোলা। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িত সঙ্ঘের নাড়িও। এই সমীকরণ মাথায় রাখলে, মোদীর পক্ষে চট করে অনুষ্ঠান এড়িয়ে যাওয়া শক্ত। কিন্তু তেমনই আবার এর জেরে তিনি ও অন্যরা করোনায় আক্রান্ত হলে, সমালোচনা ছাড়বে না প্রধানমন্ত্রীকে।
তাই দিল্লিতে কী সিদ্ধান্ত হয়, আপাতত তার প্রহর গুনছে অযোধ্যা। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে যে মন্দির-শহর কখনও দেখেনি।