আহত মহম্মদ মিনহাজউদ্দিন। (ডান দিকে) তাঁর মেডিক্যাল রিপোর্ট। —নিজস্ব চিত্র।
বিচারপতি হওয়ার স্বপ্ন বুকে পুষে বিহারের সমস্তিপুর থেকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় এসেছিলেন মহম্মদ মিনহাজউদ্দিন। কিন্তু রবিবার সন্ধেয় পুলিশের বেধড়ক লাঠি কেড়ে নিতে বসেছে তাঁর বাঁ চোখের দৃষ্টি।
কর্পোরেটে ভাল চাকরির হাত ধরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন শায়ন মুজিব। ভর্তি হয়েছিলেন বিবিএ-তে। কিন্তু পুলিশের লাঠিতে চুরমার দুই হাঁটুই। আর আমলা হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ মহম্মদ মুস্তাফা ফের কবে পেন ধরতে পারবেন সন্দেহ। কারণ, মারের চোটে ‘গুঁড়ো’ দুই হাতের হাড়।
বুধবার এই সমস্ত ঘটনার কথা তুলে এনে শতবর্ষে পা রাখা এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিখা কপূরের ক্ষোভ, ‘‘কোনও পড়ুয়া চোখ খুইয়েছেন। কারও ভেঙেছে দুই পা কিংবা দুই হাতই। অনেকে মারাত্মক আহত। গত কয়েক দিনে এঁদের রক্ত, কান্না দেখেছি। এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের কি তবে এটাই প্রাপ্য?’’
আরও পড়ুন: হিন্দুদের পথে নামানো কৌশল এখন বিজেপির
মিনহাজের বন্ধুদের দাবি, এলএলএম (এগ্জিকিউটিভ) পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিনহাজ বরাবর মুখচোরা। সে দিনও মিছিলের ত্রিসীমানায় ছিলেন না। পড়ছিলেন লাইব্রেরির দোতলার রিডিং রুমে। পুলিশ আসছে শুনেও নাকি প্রথমে না-পালিয়ে বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘‘তাতে কী? আমরা তো এখানে পড়ছি!’’
পরে কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ার পরে পালাতে চেয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছিলেন বাথরুমে। তত ক্ষণে লাঠির ঘা পড়েছে চোখে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন সেখানেই। এখন বাঁ চোখে ব্যান্ডেজ। ভেঙেছে বাঁ হাতের দুই আঙুলও।
রিপোর্ট দেখে এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘আঘাতে কর্নিয়া মাঝ বরাবর ফেটে চৌচির। সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে চোখের স্বাভাবিক লেন্স। রক্ত জমাট বেঁধে আছে চোখের পিছনেও। প্রাথমিক ভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কর্নিয়া মেরামতের চেষ্টা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে লেন্সও। কিন্তু এই চোখে কাজ করার মতো দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ।’’
ক্যাম্পাসে পুলিশি তাণ্ডবের পরে আরও বেশি করে পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিতে এ দিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিল জামিয়ার শিক্ষক সংগঠন (জেটিএ)। সেখানে সোহিনী ঘোষ, সনিয়া গুপ্ত, মণীষা শেট্টি, সাইমা, আখতারের মতো অধ্যাপকেরা বললেন, সে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, তার জন্য অবশ্যই কেন্দ্রের কাছে মোটা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন তাঁরা। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও লড়াই জারি থাকবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে। কিন্তু এতগুলো তরতাজা ছেলে-মেয়ের চোখ, পা, হাত যারা কেড়ে নিল, আগে তাদের বিচার চাইছেন তাঁরা। শিক্ষকদের দাবি, সে দিনের পর থেকে পড়ুয়াদের এক বড় অংশ মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত, অবসন্ন। সারাক্ষণ তাড়া করছে ভয়। মনের এই ক্ষত সরকার মেরামত করবে কী ভাবে, সবার আগে সরকারের কাছে সেই কৈফিয়ত চান তাঁরা।
পুলিশের লাঠিতে মাথা ফেটেছে গণমাধ্যমের ছাত্র চন্দন কুমারের। বুধবার তাঁর নামে এফআইআরও দায়ের করেছে পুলিশ। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হাতে প্রমাণ থাকলে, কেন আমাকে এখনও গ্রেফতার করেনি পুলিশ?’’
এই ক্ষোভের আঁচ এতটাই গনগনে যে, উপাচার্য পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমে কিছুটা মন পাওয়ার পরেও ক্ষোভ দানা বাঁধছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এখনও পুলিশের নামে দায়ের করা এফআইআর কিংবা অভিযোগের কপি সামনে আনেনি প্রশাসন? সিসিটিভির ফুটেজ কেন দেখানো হয়নি সংবাদমাধ্যমকে? উপাচার্যই বা সমস্ত আহত পড়ুয়াকে এখনও দেখতে যাননি কেন?
ভারতে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ ঘিরে হিংসা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ‘বাড়াবাড়ি বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ নিয়ে গত কালই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস। সওয়াল করেছেন বাক্স্বাধীনতার পক্ষে। আজ জামিয়া ক্যাম্পাসে এসেছিলেন প্রাক্তন ছাত্র-নেতা কানহাইয়া কুমার। জামিয়ার এক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘‘আমরা চাই না নতুন নাগরিকত্ব আইন আর এনআরসি-র জেরে ফের এক বার দেশ ভাগ হোক। আমাদের এক পড়ুয়ার চোখ নিয়ে এ বার অন্তত সরকারের চোখ খুলবে কি?’’