ছবি রয়টার্স।
ভারতের মতো জনবহুল দেশে ‘গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা’-র (হার্ড ইমিউনিটি) প্রাসঙ্গিকতা কতটা? এই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে-হতে বড় বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশ যে পর্যায়ে দাঁড়িয়ে, সেখানে আপাতত এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে বিজ্ঞানী-চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের মধ্যে।
তাঁদের বক্তব্য, ভারতের মতো দেশে গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে গেলে জনসংখ্যার কমপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশকে আগে সংক্রমিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে বাড়বে মৃত্যুহারও। সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে, সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এমন একটা সময় আসে, যখন জনসংখ্যার বাকি অংশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিরোধশক্তি গড়ে ওঠে।
কিন্তু বিজ্ঞানী-গবেষকদের মতে, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেখানে ছারখার করে দিয়েছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস, সেখানে ভারতের মতো ১৩৫ কোটির দেশে যদি সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তা রীতিমতো বিপজ্জনক!
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল হেল্থ’-এর ডেপুটি ডিরেক্টর পূর্ণিমা প্রভাকরণের কথায়, ‘‘কোভিডের মতো সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হার্ড ইমিউনিটি কখনওই আমাদের দেশের জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়। কারণ, বেশি সংখ্যক সংক্রমিত রোগীর চাপ সামলানোর মতো প্রস্তুতি বা পর্যাপ্ত পরিকাঠামো দেশের সিংহভাগ রাজ্যেই নেই!’’ একই কথা বলছেন কার্ডিয়োথোরাসিক চিকিৎসক কুণাল সরকারও। তাঁর কথায়, ‘‘হার্ড ইমিউনিটি তৈরির আগে যদি দেশের জনসংখ্যার ৩০-৪০ শতাংশ সংক্রমিত হয়, তা হলে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।’’
আরও পড়ুন: করোনা সারাতে সিদ্ধায় ভরসা তামিলনাড়ু সরকারের
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর এমেরিটাস বিজ্ঞানী ও এমস-এর প্রাক্তন ডিন নরেন্দ্র কে মেহরা আবার জানাচ্ছেন, যত ক্ষণ না কোভিডের প্রতিষেধক বা ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে বা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হচ্ছে তত ক্ষণ সংক্রমণ রুখতে মাস্ক পরা, হাত ধোওয়া, দূরত্ব-বিধি মানা-সহ যাবতীয় নিয়মকানুন নিয়মিত মেনে চলতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘উপসর্গহীন ও অল্প উপসর্গ রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও সংক্রমণ বাড়তে থাকলে অনেকেরই হাসপাতালে ভর্তির পরিস্থিতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে মৃত্যুহার বাড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।’’
যদিও গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতার পক্ষে ‘মাইক্রোবায়োলজিস্টস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’-র প্রেসিডেন্ট এ এম দেশমুখ বলছেন, ‘‘শুধু সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা নিয়ে হইচই করলে হবে না। সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা ও অত্যন্ত কম মৃত্যুহারের বিষয়টিও দেখতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে হার্ড ইমিউনিটি এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার অন্যতম পথ।’’ মাইক্রোবায়োলজিস্ট তথা বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান রাজেশ কুমারেরও বক্তব্য, ‘‘গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে একটু সময় লাগলেও এই মুহূর্তে সেটিই হল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সেরা বিকল্প পথ।’’
আরও পড়ুন: লকডাউন উঠতেই বেকারত্ব কমেছে ভারতে, গ্রামের দৌলতেই
গবেষকদের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির তত্ত্বটি আসলে জনমানসে ভয়-ভ্রান্তি কাটানোর জন্য পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দেশের মৃত্যুহার কতটা কম, সেটাই অনেকে তুলে ধরছেন। হু-র রিপোর্ট উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকও যেমন জানিয়েছে, যেখানে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, আমেরিকা ও জার্মানির মৃত্যুহার যথাক্রমে ৬৩.১৩, ৬০.৬, ৫৭.১৯, ৩৬.৩ এবং ২৭.৩২, সেখানে ভারতে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মৃত্যুহার হল ১। যার পরিপ্রেক্ষিতে গবেষকদের সতর্কবার্তা, মৃত্যুহার কম বলে আত্মসন্তুষ্টির কোনও জায়গা নেই।
তার কারণ ব্যাখ্যা করে মাইক্রোবায়োলজিস্ট সুখেন্দু মণ্ডল জানাচ্ছেন, ভারতের মতো ১৩৫ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের দেশে গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে গেলে জনসংখ্যার যদি ৩০ শতাংশও সংক্রমিত হয়, তা হলেও দেশে মোট সংক্রমিত রোগীর সম্ভাব্য সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪০ কোটি ৫৯ লক্ষে! তাঁর কথায়, ‘‘তখন মৃত্যুহারের বিষয়টি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে! কারণ, তখন পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। ফলে হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্বগত ভাবে যতটা বলা সহজ, বাস্তবে একদমই তা নয়।’’