—প্রতীকী ছবি।
‘জল জীবন মিশন’-এর কাজ কেমন হয়েছে? এ গ্রামের সব বাড়িতে জলের পাইপ এসেছে?
বানোয়ারি লাল মীনা ঘাড় নাড়েন। তার উত্তর, হ্যাঁ হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। কারণ, বাড়িতে জলের পাইপ এসেছে। তবে জল এখনও আসেনি।
‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর কাজ শেষ? গ্রামের সব বাড়িতে শৌচালয় হয়েছে?
এ বারও একইভাবে ঘাড় নাড়েন বানোয়ারি লাল। সব বাড়িতে শৌচালয় হয়েছে। তবে ওই যে, জল নেই! পানীয় জলেরই টানাটানি। তার আবার শৌচকর্ম! তাই ভোরে উঠে ফাঁকা জমি বা জঙ্গলেই যেতে হয়।
জয়পুর থেকে শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরে মহারাজা মাধো সিংহ প্রাচীর ঘেরা শহর তৈরি করিয়েছিলেন। তারই নাম সওয়াই মাধোপুর। জেলার শিওয়াড় কসবা। ঠেলাগাড়িতে করে আট-দশ বালতি ভর্তি জল নিয়ে চলেছেন বানোয়ারি লাল ও তাঁর স্ত্রী। জলের ট্যাঙ্কার আসে বাড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে। জল ভরার লাইনে দিন কেটে যায়। তার পরে ঠেলাগাড়ি ভর্তি বালতি নিয়ে বাড়ির পথ ধরা।
ভোট আসে। ভোট যায়। রাজস্থানে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল হয়। বানোয়ারি লালদের জলের সমস্যার কোনও রদবদল হয় না। কংগ্রেস নেতারা আসেন। বিজেপি নেতারা ঘুরে যান। তাঁদের কেউ পানীয় জলের সমস্যা মিটিয়ে দেবেন শুনলে বানোয়ারি লালেরা আর সে কথা কানেই তোলেন না। বিশ্বাস করা দূরের কথা!
সওয়াই মাধোপুর থেকে অজমেঢ়, ভরতপুর থেকে আলওয়াড়, দৌসা থেকে বু্ন্দি, ঢোলপুর থেকে ঝালওয়ার-বারান—রাজস্থানের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ১৩টি জেলা জুড়ে বছরের পর বছর পানীয় জল ও সেচের জলের সমস্যা। পূর্ব রাজস্থান বরাবরই কংগ্রেসের গড় বলে পরিচিত। পাঁচ বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব রাজস্থানের ৮৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কংগ্রেস ৪৩টি জিতেছিল। অশোক গহলৌতের কংগ্রেস সরকার ঘোষণা করেছিল, ‘ইস্টার্ন রাজস্থান ক্যানাল প্রোজেক্ট’-এর কাজ শুরু হবে। গোটা পূর্ব রাজস্থানের জলের অভাব মিটে যাবে। চম্বল নদী ও তার বিভিন্ন উপনদীর জল খাল কেটে পূর্ব রাজস্থানের জেলায় জেলায় পৌঁছে দেওয়া হবে। রাজনীতির জটে চম্বলের জল আটকে গিয়েছে।
বিজেপি বলছে, ওই পরিকল্পনা তো গহলৌতের এই সরকার আসার আগে বিজেপির আমলে তৈরি। গহলৌত তার কৃতিত্ব কেন নিতে চাইছেন কেন? অন্য দিকে কংগ্রেসের অভিযোগ, বিজেপি জলের সমস্যা নিয়েও রাজনীতি করছে। তাই প্রতিশ্রুতি দিয়েও নরেন্দ্র মোদীর সরকার ইস্টার্ন রাজস্থান ক্যানাল প্রোজেক্ট-কে ‘জাতীয় প্রকল্প’ ঘোষণা করেনি। তা হলে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ খরচই কেন্দ্রের থেকে মিলত। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দরকার নেই কেন্দ্রের টাকা। রাজ্য সরকার নিজের সিন্দুক থেকেই ৯,৬০০ কোটি টাকা খরচ করে ২০২৭-এর মধ্যে কাজ শেষ করবে। বিজেপি ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা রাজস্থানে ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিডেপি-র ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার মিলে এই প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করবে।
জয়পুর গ্রামীণ কেন্দ্র থেকে লোকসভার সাংসদ হয়েছিলেন রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর। তিনি এ বার ওই এলাকারই বিধানসভা কেন্দ্র ঝোটওয়াড়া থেকে ভোটে লড়ছেন। মাথায় পাগড়ি বেঁধে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সমস্যার কথা শুনছেন। শুটার রাজ্যবর্ধন কমনওয়েলথ গেমসে সোনা, অলিম্পিক্সে রুপো জিতেছিলেন। কিন্তু শুখা মাটি খুঁড়ে জল বার করে আনার লক্ষ্যভেদের কৌশল তাঁরও জানা নেই। ঝোটওয়াড়ার বাসিন্দা সুমিত্রা দেবী নালিশ করেন, তিন দিন অন্তর চারশো টাকা খরচ করে পাঁচশো লিটারের জলের ট্যাঙ্ক কিনতে হয়।
সওয়াই মাধোপুরের গোপালপুরা গ্রামে চারটি বোরওয়েল বসানো হয়েছিল। তার তিনটিতে এখন আর জল ওঠে না। একটিতে ওঠে। সেই জল কে পাবে, তা নিয়ে গুর্জর, মীনা সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গাও হয়ে গিয়েছে। আগে সেচের জল পেতে মাটির ৯০ ফুট গভীরে যেতে হত। এখন তিনশো-চারশো ফুট গেলে জল মেলে। টঙ্ক জেলার সোদা গ্রামে এক সময় সরপঞ্চ হয়েছিলেন ছবি রাজাওয়াত। মহিলাদের নিয়ে জলের সমস্যা মেটাতে অনেক কাজ করেছিলেন। তাঁর আফশোস, “রাজনীতিকরা ভোটের সময় এসে জলের সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি দিলে আগে লোকে আশায় বুক বাঁধত। এখন সবাই বুঝে গিয়েছে, কিছু হবে না। পানীয় জল, ঘরের কাজকর্মের জলের অভাবও মিটবে না। তাই মানুষও এখন জলের সমস্যা সমাধানের দাবি করেন না। রাজস্থানের নেতারাও বুঝে গিয়েছেন, জলের অভাব না মিটিয়েও ভোটে জেতা যায়।”
রাজস্থানেরই বিজেপি নেতা গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াত কেন্দ্রীয় সরকারের জলশক্তি মন্ত্রী। জল জীবন মিশন-এ প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর ‘হর ঘর জল’-এর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন। শেখাওয়াতের কাঁধেই দেশের সব গ্রামের বাড়িতে নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব। অশোক গহলৌত প্রচারে নেমে অভিযোগ করছেন, শেখাওয়াতের জন্যই রাজস্থানে জলের সমস্যা মেটে না। আর শেখাওয়াতের মন্ত্রক বলছে, গহলৌতের সরকারের জন্যই রাজস্থান নলবাহিত জল পৌঁছে দেওয়ার কাজে পিছনের সারিতে। প্রকল্প শুরুর পরে চার বছর কেটে গেলেও রাজ্যের অর্ধেক গ্রামের বাড়িতে নল পৌঁছয়নি।
ভোটের বাজারে এই রাজনীতির বাকবিতণ্ডা শুনে বানোয়ারি লাল মীনা হাসেন। নল তো বসানো হবে। সেই নলে জল আসবে কোথা থেকে! পানীয় জল ভরে আনতে ট্যাঙ্কারের কেনা জলই উপায়। আর শৌচকর্ম? ওই ফাঁকা জমি বা জঙ্গলই ভরসা।