উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিশেষ নজর ১০ বিধানসভা কেন্দ্রে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
অযোধ্যায় জয় বিজেপি প্রার্থী বেদপ্রকাশ গুপ্তের। জয়ের ব্যবধান ২০ হাজারের বেশি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র তেজ নারায়ণ।
১৯৯২ সাল বা তার আগে থেকেই দেশের আলোচনার কেন্দ্রে অযোধ্যা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে নজরে সারা দুনিয়ার। তিন দশক কেটে গিয়েছে। কিন্তু ওই ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। ১৯৯২ সাল থেকেই অযোধ্যা কার দখলে, তার উপর বিশেষ নজর থাকে দেশবাসীর। কিছুকাল আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছএন। ওই মন্দির এবং তার লাগোয়া চত্বরের জন্য ৯০০ থেকে ১,০০০ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ ধরা হয়েছে। ফলে উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশিই আগ্রহ ছিল অযোধ্যা নিয়েও। ২০১৭ সালে অযোধ্যা কেন্দ্র থেকে জিতেছিল বিজেপি। বিধায়ক হয়েছিলেন বেদপ্রকাশ গুপ্ত। ২০২২ সালের নির্বাচনেও তিনিই বিজেপি-র প্রার্থী ছিলেন। ওই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী রীতা মৌর্যকেই তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করা হচ্ছিল।
প্রত্যাশা মতোই বারাণসী (উত্তর) কেন্দ্রে জয়ী বিজেপি প্রার্থী রবীন্দ্র জয়সবাল। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী আশফাক।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্রে তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। তিনটির নামের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে ‘বারাণসী’র নাম। বারাণসী (উত্তর), বারাণসী (দক্ষিণ), বারাণসী (ক্যান্টনমেন্ট)। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বারাণসী থেকে বিপুল ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মোদী। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি। মোদীর কারণেই বারাণসী লোকসভার অন্তর্গত তিনটি কেন্দ্রের রাজনৈতিক চাপানউতরের গুরুত্ব গড়পরতা বাকি কেন্দ্রগুলির থেকে একটু বেশি। এই তিন কেন্দ্র নজরে থাকার আরও কারণ কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এবং জ্ঞানবাপী মসজিদের মধ্যে জারি তরজা। হিন্দুত্ববাদী একাংশের দাবি, মোগল আমলে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একাংশ দখল করে তৈরি করা হয়েছিল জ্ঞানবাপী মসজিদ। ওই মসজিদ ভেঙে বিশ্বনাথ মন্দির চত্বর প্রশস্ত করার দাবি জানান হিন্দুত্ববাদীরা। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে।
বারাণসী (দক্ষিণ) কেন্দ্রে গণনার শুরু থেকেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বিজেপি এবং এসপি-র মধ্যে। তবে গণনা শেষে ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে জয়ী হলেন বিজেপি-র নীলকণ্ঠ তিওয়ারি। লড়াই চলছিল সমাজবাদী পার্টির কামেশ্বর দীক্ষিতের সঙ্গে।
উত্তরপ্রদেশে সাত দফা ভোটের মধ্যে এই আসনে ভোট হয়েছিল সপ্তম দফায়। ৭ মার্চ। লড়াই ছিল পঞ্চমুখী। ময়দানে ছিলেন বিজেপি-র নীলকন্ঠ তিওয়ারি, সমাজবাদী পার্টির কামেশ্বর দীক্ষিত, কংগ্রেসের মুদিতা কপূর, আপ-এর অজিত সিংহ এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির দীনেশ কাসাউধন। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বারাণসী (দক্ষিণ) কেন্দ্রে জয়লাভ করে বিধায়ক হয়েছিলেন বিজেপি-র প্রার্থী নীলকান্ত। ২০২২ সালের নির্বাচনেও তিনিই বিজেপি-র প্রার্থী।
বারাণসী (ক্যান্টনমেন্ট) কেন্দ্রে জয়ী বিজেপি প্রার্থী সৌরভ শ্রীবাস্তব। জয়ের ব্যবধান ৮৬ হাজারেরও বেশি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী পূজা যাদব।
পুরনো বারাণসী শহর থেকে বারাণসী ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ধাঁচ খানিকটা আলাদা। এই এলাকায় অলিগলি নেই। রাস্তায় অটো-টোটোর ভিড় নেই। কিলবিলে ভিড় নেই সারা দেশ ঝেঁটিয়ে-আসা তীর্থযাত্রীদেরও। এই কেন্দ্রেও ভোট হয়েছিল সপ্তম দফায়, ৭ মার্চ। এই আসনেও লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন পাঁচটি দলের প্রার্থী। বিজেপি-র সৌরভ শ্রীবাস্তব, সমাজবাদী পার্টির পূজা যাদব, কংগ্রেসের রাজেশ মিশ্র, আপ-এর রাকেশ পাণ্ডে এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির কৌশিক কুমার পাণ্ডে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি। বিধায়ক হয়েছিলেন সৌরভ শ্রীবাস্তব। ২০২২ সালের নির্বাচনেও তিনিই বিজেপি-র প্রার্থী ছিলেন।
গোরক্ষপুর (শহর) কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ী বিজেপি প্রার্থী তথা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ দু’হাজার। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী শুভাবতী শুক্ল।
প্রার্থীর কারণেই এই কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নাম যোগী আদিত্যনাথ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, এটিই ছিল তাঁর প্রথম বিধানসভা ভোট। আগে পর পর পাঁচবার গোরক্ষপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হলেও যোগী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বিধান পরিষদের সদস্য হিসেবে। ফলে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে যে ক’টি প্রতীকই থাকুক, বাস্তবে গোরক্ষপুর শহর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী ছিলেন একজনই। এই কেন্দ্রের সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত বিজেপি নেতার স্ত্রী শুভাবতী শুক্ল। বিজেপি-র অন্দরের সমীকরণে শুভাবতীর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না যোগীর। সেই অঙ্কেই তাঁকে ভোটে দাঁড় করিয়েছিলেন সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব।
লখনউ (ক্যান্টনমেন্ট) কেন্দ্রে জয়ী বিজেপি প্রার্থী ব্রজেশ পাঠক। জয়ের ব্যবধান ৩৯ হাজার ৫১২। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী রাজু গাঁধী।
উত্তরপ্রদেশ দখলের লড়াইয়ের প্রথম ধাপ শুরু হয় যে শহর থেকে, সেই শহরের বিধানসভা কেন্দ্র তো নজরে থাকবেই। হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের যুগল ইতিহাস, মোগলাই খানা থেকে শুরু করে গেরুয়াধারী ‘হিন্দুত্বের পোস্টারবয়’ মুখ্যমন্ত্রীর আবাস— লখনউ সমস্ত দেখেছে এবং দেখছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী রীতা বহুগুণা। তবে এ বার এই কেন্দ্রে প্রার্থী বদল করেছে বিজেপি। লখনউ (ক্যান্টনমেন্ট) কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন গত বছরের লখনউ (সেন্ট্রাল) আসনের বিজেপি প্রার্থী ব্রজেশ পাঠক। যাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী রাজু গাঁধী।
হাথরস বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী অঞ্জুলা মাহোর। জয়ের ব্যবধান ৮০ হাজারেরও বেশি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বহুজন সমাজ পার্টির প্রার্থী সঞ্জীব কুমার।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে খবরের শিরোনামে এই কেন্দ্র। কারণ ১৯ বছরের এক দলিত যুবতীর গণধর্ষণের ঘটনা। নির্যাতিতাকে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে ১৫ দিন পর মৃত্যু হয় তাঁর। এর পর দেশ জুড়ে আন্দোলনে শামিল হন বিরোধীরা। নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী, চন্দ্রশেখর আজাদের মতো বিরোধী নেতারা। আটক হন অনেক নেতা। এর পর পুলিশের উপর নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের আটক করে রেখে পেট্রল ঢেলে তাঁর মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ নির্দেশে এখনও সিআরপিএফ ঘেরাটোপে বসবাস করে নির্যাতিতার পরিবার। অভিযুক্ত চার জনই আপাতত জেলে। মামলা চলছে। ২০১৭ বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিল বিজেপি। বিধায়ক ছিলেন হরিশঙ্কর মাহোর। তবে এবার পরিস্থিতি বুঝে প্রার্থী বদল করেছিল বিজেপি। লড়েছেন অঞ্জুলা মাহোর।
উন্নাও বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী বিজেপি প্রার্থী পঙ্কজ গুপ্ত। ২৭ হাজারেরও বেশি ব্যবধানে জয়ী। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী অভিনব কুমার।
হাথরসের মতোই উন্নাও। সারা দেশ উন্নাওয়ের নাম জেনে গিয়েছে গত পাঁচবছরে। বিধানসভা ভোটে সে নাম আরও পরিচিত হয়েছে। কারণ, এই কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন আশা সিংহ। উন্নাও গণধর্ষণে নির্যাতিতার মা। ২০১৭ সালে এই কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি। কিন্তু উন্নাওয়ের ১৭ বছর বয়সী তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনা বিজেপি-কে খানিকটা বেকায়দায় ফেলেছিল বলেই মনে করা হচ্ছিল। কারণ, ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বাঙ্গেরমাউ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার। নির্যাতিতার বাবা পুলিশি হেফাজতে মারা গেলে ওই ঘটনা অন্য মাত্রা পায়। বাবার ম়ৃত্যুর পর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির কাছে গিয়ে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন নির্যাতিতা। ২০১৯ সালে নির্যাতিতা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টার অভিযোগও ওঠে। ওই ঘটনায় নির্যাতিতা বেঁচে গেলেও মারা যান তাঁর পরিবারের দুই সদস্য। তবে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর কুলদীপকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রায় দেয় দিল্লির এক আদালত।
মথুরা বিধানসভা কেন্দ্রেও জয়ী বিজেপি। জয়ী প্রার্থী শ্রীকান্ত শর্মা। জয়ের ব্যবধান এক লক্ষেরও বেশি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের প্রদীপ মাথুর।
মন্দিরনগরী মথুরা নিয়ে আগ্রহ বরাবরই থাকে। এ বারেও ছিল। কারণ, মথুরায় বিজেপি জিতলে এই শহরেও মন্দির-মসজিদ বিতর্ক মাথাচাড়া দিতে পারে। জল্পনা মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরের লাগোয়া ইদগা মসজিদ নিয়ে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দাবি, মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ওই মন্দিরের একাংশ ধ্বংস করে সেখানে তৈরি করেছিলেন ওই মসজিদ। ফলে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, ওই মসজিদ সরিয়ে দিতে হবে। পাঁচ বছর আগে বিধানসভা ভোটে মথুরায় জিতেছিল বিজেপি। বিধায়ক হয়েছিলেন শ্রীকান্ত শর্মা। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন কংগ্রেসের প্রদীপ মাথুর। এই বছরের নির্বাচনে আবার মুখোমুখি হয়েছিলেন শ্রীকান্ত-প্রদীপ।
আগরা (ক্যান্টনমেন্ট) কেন্দ্রে জয়ী বিজেপি প্রার্থী জিএস ধর্মেশ। জয়ের ব্যবধান ৪৮ হাজার ৬৯৭। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এসপি প্রার্থী কুঁয়র চন্দ।
তাজমহলের শহর ভোট নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। তার চেয়ে এই শহর অনেক বেশি গুরুত্ব দেয় পর্যটন এবং তজ্জনিত অর্থনীতিকে। একেবারে প্রথম দফাতেই ভোট হয়ে গিয়েছিল আগরায়। এই শহরেও পাঁচটি দলের লড়াই হয়েছে ভোটের ময়দানে। তবে সম্প্রতি তাজমহল নিয়ে বিতর্ক বেধেছে। তাজমহল আসলে ‘তেজো মহালয়’ (শিবের আলয় বা গৃহ) বলে দাবি তুলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সেবাভারতী এবং দুর্গাবাহিনীর সদস্যরা। ঘটনাচক্রে, এই বিধানসভা আসনে সাম্প্রতিক কালে বিজেপি-ই জিতেছে। এবারেও তারাই এগিয়েছিল।