উর্জিত পটেল। —ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ে হার মানলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের মেয়াদ তিন বছর। তার পর সাধারণ ভাবে আরও দু’বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। উর্জিত গভর্নর হয়েছিলেন ২০১৬-র ৪ সেপ্টেম্বর। প্রথম দফার মেয়াদ ফুরোনোর ৯ মাস আগেই ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। এত কম সময় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদে থাকার উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে নেই।
উর্জিতের ঠিক আগেই গভর্নর ছিলেন রঘুরাম রাজন। তাঁর সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদী সরকারের মতের মিল হয়নি। ফলে তিন বছরের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই তিনি জানিয়ে দেন, আর ওই পদে থাকবেন না।
রাজনের আমলে উর্জিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর। তাঁকে যখন গভর্নর করা হয়, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন শীর্ষ ব্যাঙ্কের প্রধান পদে এক জন ‘ইয়েস ম্যান’কে নিয়োগ করলেন নরেন্দ্র মোদী। উর্জিত দায়িত্ব নেওয়ার দু’মাসের মাথায় নোটবন্দি আরও ধারালো করে সমালোচকদের জিভ।
এহেন উর্জিতের সঙ্গেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত বনিবনা হল না কেন্দ্রের। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে টাকা চেয়ে চাপ বাড়ছিল। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় নগদের জোগান নিয়েও মতপার্থক্য দেখা দেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে নজিরবিহীন ভাবে ‘পরামর্শ’ও দেয় কেন্দ্র। এই অবস্থায় ‘স্বাধীনতা’ বজায় রাখার লড়াইটা উর্জিত চালিয়ে যেতে পারেন কি না, সেটাই দেখার ছিল। কিন্তু সোমবার ময়দান ছাড়লেন তিনি। এর আগে মোদীর বাছাই করা আরও দুই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দায়িত্ব ছেড়েছেন। নীতি আয়োগ থেকে অরবিন্দ পানাগড়িয়া এবং আর্থিক উপদেষ্টার পদ থেকে অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন।
আরও পড়ুন: ক্ষোভ, আশঙ্কা...তবু যেন হওয়ারই ছিল
সোমবার বিকেলে ছোট্ট বিদায় বার্তায় যাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন উর্জিত, তাঁদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী নেই। তাঁর এই বিবৃতিকে ‘প্রতিবাদপত্র’ হিসেবেই দেখেছেন রঘুরাম। মোদী এবং অরুণ জেটলি অবশ্য উর্জিতের প্রশংসাই করেছেন।
গত ১৯ নভেম্বর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ডের বৈঠকে সংঘাতের বিষয়গুলি নিয়ে কমিটি তৈরি হয়। ১৪ তারিখ ফের বোর্ডের বৈঠক ছিল। এর মধ্যে মোদীর সঙ্গে দেখা করেছেন উর্জিত। তার পরেও তাঁর ইস্তফায় প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কী হল?
আরও পড়ুন: মাল্যের প্রত্যর্পণে সায় ব্রিটিশ কোর্টের, বড় জয় বললেন জেটলি
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের দাবি, উর্জিত যে এ দিনই পদত্যাগ করবেন, তা জানা ছিল না। কিন্তু আর একটি সূত্র বলছে, আজ প্রকাশিত জেটলির একটি সাক্ষাৎকারও এর কারণ হতে পারে। ওই সাক্ষাৎকারে জেটলি বলেছেন, ‘সেবি, ট্রাই-এর মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন জানানোর সুযোগ রয়েছে। এই ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপরে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায় বর্তায়।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নাম না করলেও জেটলির যুক্তি, তত্ত্ব দিয়ে নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিস্থিতি, বাজার দেখেই আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বোর্ডের আগামী বৈঠকে আরও চাপ তৈরি করবে সরকার।
লোকসভা ভোটের আগে ছোট শিল্পের জন্য নগদ জোগানো বা ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ দিতে ১১টি দুর্বল সরকারি ব্যাঙ্কের উপর থেকে বিধিনিষেধ আলগা করার জন্য চাপ ছিলই। সর্বোপরি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে থাকা ৯.৬ লক্ষ কোটি টাকার ভাগ চেয়ে বসে অর্থ মন্ত্রক। কালো টাকা ফিরিয়ে এনে সকলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। ব্যর্থ হয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, লোকসভা ভোটের আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারের টাকা দিয়ে সকলের জন্য ন্যূনতম আয় বা ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’-এর মতো চমক দিতে চায় মোদী সরকার।
বিরোধীদের একাংশের এ-ও অভিযোগ, ধনী শিল্পপতিদের চাপেই উর্জিতকে হটানো হল। কারণ, সুদ শোধ করতে শিল্প সংস্থাগুলির এক দিন দেরি হলেই ব্যাঙ্কগুলিকে পদক্ষেপ করতে বলেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
উর্জিতের পাশে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী এ দিন বলেন, ‘‘মরিয়া হয়ে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করছে, যা দেশের জন্য বিপজ্জনক।’’
উর্জিতের বিদায় আরও একটি জরুরি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তা হল, সঙ্ঘ পরিবারের ‘স্বদেশি’ অর্থনীতিবিদরা নাক গলাচ্ছেন বলেও কি উর্জিত, রঘুরাম, অরবিন্দরা টিকতে পারলেন না? রঘুরাম ও পানাগড়িয়াকে নিশানা করেছিল গেরুয়া শিবির। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ডে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ এস গুরুমূর্তিকে মনোনীত করে মোদী সরকার। ফলে চাপ বাড়ে উর্জিতের।
মোদী সরকার বনাম রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সংঘাত প্রকাশ্যে আসে ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য মুখ খোলায়। উর্জিতের সঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করবে কি না, সেই জল্পনা তুঙ্গে। সূত্রের খবর, আপাতত প্রবীণতম ডেপুটি গভর্নর এন বিশ্বনাথন গভর্নরের কাজ চালাবেন।