এখন প্রশ্ন হল, নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে বিপুলতম ব্যবধানে জিতে কি যোগী নিজেকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলবেন? তিনি কী ছিলেন, তার উদাহরণ লখনউয়ের ক্ষমতার অলিন্দে কান পাতলেই শোনা যায়। তিনি কী হবেন, সেটাই দেখার।
গণনাটা কেবল ঔপচারিকতা ছিল। গোরক্ষপুর শহরে জীবনের প্রথম বিধানসভা ভোট লড়তে নেমে প্রথম রাউন্ড থেকেই একেবারে প্রথমে যোগী আদিত্যনাথ। নমুনা দেওয়া যাক। গোরক্ষপুর (শহর) আসনে প্রথম রাউন্ডের গণনায় যোগী পেয়েছেন ৫,৫৪০ ভোট। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী শুভাবতী শুক্ল ১,০৭৬ ভোট। এবং, যাঁকে নিয়ে কৌতূহল ছিল, সেই দলিত প্রার্থী চন্দ্রশেখর আজাদ (রাবণ) পেয়েছেন ১৩৩টি ভোট!
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে যে উল্কার গতিতে যোগীর উত্থান হয়েছে, তাতে এমনিতেই তাঁর ভাবমূর্তি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। ফলে যে গোরক্ষপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে তিনি পাঁচ-পাঁচবার সাংসদ হয়েছেন, সেখানে যে তিনি জিতবেন, তা নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। যোগীরও নয়। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি নিজে অযোধ্যা থেকে ভোট লড়তে চেয়েছিলেন। রাজি হননি বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
জনশ্রুতি হল, বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগীর সম্পর্ক খুব একটা ‘মসৃণ’ নয়। যদিও এর কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন কখনও মেলেনি। কিন্তু গোরক্ষপুর (শহর)-সহ উত্তরপ্রদেশ জয় যে এমনিতে খর্বকায় যোগীর ভাবমূর্তি আরও বেশ কয়েক ইঞ্চি বাড়িয়ে দিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এখন প্রশ্ন হল, নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে বিপুলতম ব্যবধানে জিতে কি যোগী নিজেকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলবেন? তিনি কী ছিলেন, তার উদাহরণ লখনউয়ের ক্ষমতার অলিন্দে কান পাতলেই শোনা যায়। তিনি কী হবেন, সেটাই দেখার।
২০২১-এর জুলাই মাস। লখনউয়ের ‘লোকভবনের’ চার তলায় বসে মধ্য-পঞ্চাশ। ‘অনারেবল সিএম’-এর (মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী) ডাকের অপেক্ষায়। কিন্তু সেই ডাক আর আসেনি। ঠায় বসে থাকার পর এক সময় রণে ভঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে আসেন দর্শনার্থী।
অপেক্ষায় যিনি ছিলেন, তাঁর নাম অরবিন্দ কুমার (একে) শর্মা। আর যাঁর প্রতীক্ষায় ছিলেন, তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
কে একে শর্মা? কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ? ১৯৮৮ ব্যাচের গুজরাত ক্যাডারের আইএএস আধিকারিক রাজধানী দিল্লির আমলা মহলে সমধিক পরিচিত নরেন্দ্র মোদীর ‘নিকটতম’ বলে। গত বছর পর্যন্তও দিল্লিতে জোরাল জল্পনা ছিল, করোনা মোকাবিলায় যোগীর ব্যর্থতার কারণে অসন্তুষ্ট মোদী তাঁর সঙ্গে জুড়ে দিতে চান ঘরের লোক একে-কে। পরিচিত লোকগাথা হল, সেই একে-কেই নিজের কার্যালয়ে অপেক্ষায় বসিয়ে রেখে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ দেখা পর্যন্ত করেননি।
করোনাচিত্রে ক্রমশ ‘বিপজ্জনক’ দিকে যাওয়া বারাণসীতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় একে-কে পাঠিয়েছিলেন স্থানীয় সাংসদ প্রধানমন্ত্রী মোদী। কাজ হয়েছিল অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের দ্রুততায়। কিন্তু মোদীর ‘চোখের বালি’ হয়ে গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের সামগ্রিক কোভিডচিত্র। গঙ্গার চর ধরে কমলা শালুতে মোড়া মৃতদেহের সারি আর অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করে মরা লাশ সিঁদুরে মেঘ দেখিয়েছিল বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। শোনা যায়, মোদী ২০২২-এর ভোটের কথা ভেবে একে-কে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ পাঠাতে চেয়েছিলেন।
এটা কি ঔদ্ধত্য? উত্তর যা-ই হোক, সেই যোগীকেই উত্তরপ্রদেশের জন্য ‘উপযোগী’ বলে প্রকাশ্য মঞ্চে ঘোষণা করতে হয়েছিল খোদ মোদীকেই। দু’টি ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র মাস ছয়েক। উত্তরপ্রদেশের মানুষ বলেন, ‘বাবা অ্যায়সে হি হ্যায়।’ যোগী এ রকমই।
প্রাক্ নির্বাচনী সমীকরণ বলছিল, উত্তরপ্রদেশ যোগীর কাছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। জিতলে ‘সিকন্দর’ তো হবেনই, সরাসরি চ্যালেঞ্জ যাবে বিজেপি-র শীর্ষস্থানেও। আর হারলে, হয়তো তলিয়েই যাবেন চিরতরে।
এই যোগী আদিত্যনাথই ২০১৭-এর বিধানসভার পর সবাইকে টপকে কী ভাবে যে লখনউয়ের তখ্তে বসে পড়লেন, তা এখনও রহস্য। কেউ বলেন, আরএসএস-এর চাপ। আবার অনেকে বলেন, তিনি হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’। অতএব বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য যোগ্যতম। কারণ যা-ই হোক, গোটা পাঁচ বছর দাপটে রাজ্য চালিয়েছেন আদিত্যনাথ। এক দিকে জনপ্রিয়তার প্লাবন, অন্য দিকে বিরোধিতা, এবং সমালোচনার আঁধি— এ সব মিলিয়েই যোগী আদিত্যনাথ।
১৯৯০-এ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথের মন্দিরে। প্রায় তিন দশক পর সেখান থেকে সোজা লখনউয়ের ৫ নম্বর কালিদাস মার্গে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন। এই গোটা যাত্রাপথে যোগীর পরিচয়— হিন্দুত্ববাদের প্রবল সমর্থক, কঠোর প্রশাসক, ব্যক্তিগত দুর্নীতির লেশমাত্র নেই। গোবলয়ের রাজনীতিতে এর চেয়ে জোরাল মিশেল পাওয়া মুশকিল!
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভোটের আগে অনর্গল আশি-বিশের সমীকরণ, বিরোধিতা গুড়িয়ে দিতে ‘বুলডোজার তত্ত্ব’। সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘ফায়ার ব্র্যান্ড’ রাজনীতিক হিসেবে রাজ্যের ভিতরে-বাইরে আদিত্যনাথ ছিলেন নির্বিকল্প।
সমালোচকরা অবশ্য বলেন, যোগীর ভাষণে অর্থপূর্ণ দিশার বড় অভাব। কেবল মেরুকরণের প্রচ্ছন্ন খোঁচায় ভরা। থাকে না চাকরির কথা। না শিল্পায়নের ভাবনা। আর আদিত্যনাথের ভক্তদের দাবি, ‘বাবা’ সেটাই বলেন, জনতা ঠিক যেটা শুনতে চায়। বুলডোজারের গুঁতোয় যে ভাবে তিনি সমাজবিরোধীদের (বিরোধীদের অভিযোগ, বেছে বেছে সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে চান,‘ সিএএ’ বিরোধীদের বাড়িতে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের ক্ষতিপূরণের বিল পাঠান, সেই অনায়াস কায়দাতেই মন্দিরে প্রবেশের রাস্তা আরও প্রশস্ত করতে নামান বুলডোজার। কিন্তু বাকিদের সঙ্গে পার্থক্যটা হল, জনতা মেনেও নেয়। কষ্টেসৃষ্টে হলেও নেয়। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, সমষ্টির জন্য ‘বাবা’ ঠিক করছেন।
মাতামাতির তুফানের পাশাপাশি বিরোধিতার চোরাস্রোতও থাকে। যোগীর আমলে যে ভাবে রাজ্য জুড়ে কেবলমাত্র ঠাকুর সম্প্রদায়ের বাড়বাড়ন্ত, তাতে না কি ক্ষুব্ধ ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। রাজ্যের শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যেও যোগীর জনপ্রিয়তা নিম্নগামী বলে দাবি করেছিল বিভিন্ন মহল। কিন্তু যোগী জানতেন, সবাইকে জেতা যায় না। তাই সে চেষ্টা করাই বৃথা। তাঁর ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ ঠিক করা ছিল। আছে থাকবে। যেমন বলেন তাঁর ভক্তরা— ‘‘বাবা অ্যায়সে হি হ্যায়!’’