এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার এবং মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।
দলের রাশ হাতে রাখা নিয়ে এনসিপিতে কাকা এবং ভাইপোর লড়াই সোমবার প্রকাশ্যে এসে গেল। একনাথ শিন্ডে-বিজেপি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন অজিত পওয়ার। অজিতের সঙ্গে রবিবার মহারাষ্ট্র সরকারের অংশ হতে শপথগ্রহণ করেছেন আরও আট জন এনসিপি বিধায়ক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভাইপোর অনুগামীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে আসরে নামলেন এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার। রাজ্যসভার সাংসদ তথা একদা ‘ঘনিষ্ঠ’ প্রফুল্ল পটেলকে বহিষ্কার করলেন ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’। বহিষ্কার করা হল লোকসভার সাংসদ সুনীল তটকরেকেও। তাঁর কন্যা অদিতি রবিবার অজিতের সঙ্গেই শপথগ্রহণ করেছিলেন। একইসঙ্গে আরও তিন দলীয় বিধায়ককে বহিষ্কার করেছেন পওয়ার।
এনসিপি প্রধানের পদক্ষেপের পাল্টা আসরে নামে অজিতগোষ্ঠী। প্রফুল্ল পটেল ঘোষণা করেছেন, জয়ন্ত পাতিলকে সরিয়ে এনসিপির রাজ্য সভাপতি করা হচ্ছে তটকরেকে। তাঁকে অজিত পওয়ার নিয়োগ করেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। ফলে এনসিপির অন্দরে কাকা বনাম ভাইপোর লড়াই আরও তীব্র হল বলেই মনে করা হচ্ছে। শিবসেনার মতো এ বার এনসিপির রাশ কার হাতে থাকবে, সেই নিয়েও দু’পক্ষের দ্বৈরথ জোরদার হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এনসিপি সভাপতি হিসাবে শরদের উপরই আস্থা রাখার বার্তা দিয়েছেন অজিত। বলেছেন, ‘‘এনসিপি সভাপতি শরদ পওয়ারই।’’
পওয়ার-প্লে
রবিবার অজিতের সিদ্ধান্তে তিনি যে বিব্রত নন, সেই বার্তা দিয়েছিলেন শরদ। একই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, যাঁরা দলবিরোধী কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। অজিত-সহ নয় বিধায়কের পদ খারিজের দাবি জানিয়েছে এনসিপির শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। এই আবহেই সোমবার প্রথমে দলের তিন বিধায়ককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয় এনসিপি। তাঁরা হলেন মুম্বই ডিভিশনাল এনসিপি প্রধান নরেন্দ্র রাঠৌর, সেই দলের আকোলা সিটি জেলা প্রধান বিজয় দেশমুখ এবং শিবাজীরাও গারজে। ওই তিন জনই রবিবার অজিতের সঙ্গী হয়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সেই কারণেই তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। এর পর পরই প্রফুল্ল পটেল এবং সুনীল তটকরেকে বহিষ্কারের কথা নিজেই টুইট করে জানান পওয়ার। তিনি লেখেন, ‘‘ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) সভাপতি হিসাবে দলবিরোধী কাজের জন্য সুনীল তটকরে এবং প্রফুল্ল পটেলকে দল থেকে সরানো হল।’’
শরদকে পাল্টা অজিতের
দলের সভাপতির একের পর সিদ্ধান্তের পাল্টা পদক্ষেপ করে অজিত শিবির। প্রফুল্ল পটেল ঘোষণা করেছন, জয়ন্ত পাতিলকে সরিয়ে এনসিপির রাজ্য সভাপতি করা হচ্ছে তটকরেকে। তাঁকে অজিত পওয়ার নিয়োগ করেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। পওয়ারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘দলের অধিকাংশ নেতা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা মেনে নেওয়ার জন্য শরদ পওয়ারকে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা ওঁর আশীর্বাদ চাই।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘কোনও দলই বিধায়ক পদ খারিজ বা সাসপেনশন করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনেরও কোনও অধিকার নেই। এক মাত্র স্পিকারের (বিধানসভা) অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। স্পিকারের অনুমোদন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।’’ শিবসেনার মতো এনসিপিও কি ভেঙে দু’টুকরো হবে? অজিতগোষ্ঠীর পদক্ষেপের পর এমন জল্পনাই ছড়ায়। এই জল্পনা উস্কে পটেল বলেছেন, ‘‘দলের মধ্যে যদি কোনও সমস্যা হয়, তা হলে নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে, দল এবং প্রতীক কার।’’ যদিও দলীয় সভাপতি হিসাবে কাকার উপরই আস্থা রাখার বার্তা দিয়েছেন অজিত। বলেছেন, ‘‘শরদ পওয়ারই এনসিপির সভাপতি।’’ রবিবারই অজিত জানিয়েছিলেন যে, আগামী সব নির্বাচনে তাঁরা এনসিপির প্রতীকেই লড়বেন।
কী ঘটেছিল রবিবার
রবিবার দুপুরে হঠাৎই অনুগামী বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে রাজভবনে যান অজিত। তার পরই হাত মেলান শিন্ডে-বিজেপি সরকারের সঙ্গে। উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন পওয়ারের ভাইপো। তাঁর সঙ্গে আরও আট এনসিপি বিধায়ক শপথগ্রহণ করেছেন। তাঁরা হলেন, ছগন ভুজবল, দিলীপ ওয়ালসে পাটিল, অদিতি তটকরে, ধনঞ্জয় মুন্ডে, হাসান মুশারিফ, ধরমরাজ বাবারাও আতরাম, সঞ্জয় বাঁসোদে এবং অনিল ভাইদাস পাটিল। এই আট জনের মধ্যে চার জনের বিরুদ্ধেই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখা তদন্ত চালাচ্ছে। সমবায় এবং সেচ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে অজিত পওয়ারের বিরুদ্ধে। বেআইনি বরাতে অভিযুক্ত ছগন ভুজবল, অদিতি তটকরের বাবা সুনীল তটকরে, হাসান মুশারিফদের বিরুদ্ধেও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রফুল্ল পটেলের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে ইডি। ২০২২ সালে তাঁর সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। বিরোধীদের প্রশ্ন, ইডির হাত থেকে বাঁচতেই কি বিজেপির হাত ধরলেন অজিতরা।
অজিতের বিদ্রোহ
২০১৯ সাল। সেই বছরই কাকা এবং ভাইপোর বিদ্রোহ প্রকাশ্যে এসেছিল। সে বছর বিজেপিকে সমর্থন জানিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথগ্রহণ করেছিলেন অজিত। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস। তবে সেই সরকার বেশি দিন টেকেনি। কংগ্রেস, শিবসেনা এবং এনসিপি জোট বেঁধে ‘মহাবিকাশ আঘাডী’ সরকার তৈরি করে মহারাষ্ট্রে। এর পর, আবার অবস্থান বদলে ‘কাকা’র শিবিরে ফিরেছিলেন অজিত। ২০২২ সাল পর্যন্ত ‘মহাবিকাশ আঘাডী’ সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী পদেই ছিলেন অজিত। কিন্তু গত বছর জুন মাসে শিবসেনায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে সরকার ফেলে দেন একনাথ শিন্ডে। সেই সময় থেকে মহারাষ্ট্র বিধানসভার বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব ‘ভাইপো’র হাতে তুলে দেন শরদ। তখন শিন্ডেদের সঙ্গে অজিত হাত মেলাতে পারেন বলে জল্পনা ছড়িয়েছিল, যদিও সেই সময় তেমনটা ঘটেনি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নতুন করে ওই সম্পর্কের ‘চিড়’ ধরা পড়েছিল। বিজেপি-শিন্ডে সরকারকে অজিত সমর্থন জানাতে পারেন— এমনই জল্পনা জল-হাওয়া পেয়েছিল সে রাজ্যের রাজনীতিতে। এই জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল, যখন এনসিপির একাধিক কর্মসূচিতে গরহাজির থাকতে শুরু করলেন অজিত। ওই সময় অজিতের বিভিন্ন বক্তব্য বেশ ইঙ্গিতবাহী ছিল। কখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেছেন, আবার শিন্ডের সরকারকে সহজে ফেলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন অজিত। এই আবহে দলের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা জানিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করেন শরদ। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই জুন মাসে কন্যা সুপ্রিয়া সুলে এবং প্রফুল্ল পটেলকে দলের কার্যনির্বাহী সভাপতি পদে নিযুক্ত করেন পওয়ার। উল্লেখযোগ্য ভাবে দলীয় কোনও পদ পাননি অজিত। সেই সময় প্রকাশ্যে দলীয় পদ চেয়েছিলেন অজিত। এ-ও জানিয়েছিলেন, তিনি আর বিরোধী দলনেতা হিসাবে দায়িত্ব সামলাতে চান না। এই ঘটনায় ‘কাকা’র সঙ্গে ‘ভাইপো’র সম্পর্কের ‘তিক্ততা’ আরও প্রকট হয়েছিল। তার পরই নতুন করে অজিতের বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সেই জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন করে শোরগোল ফেলে দিলেন পওয়ার-ভাইপো।