মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথের পরে উদ্ধব ঠাকরে। বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ে। পিটিআই
সাত বছর আগে নভেম্বরের এক সন্ধেয় এই বিরাট ময়দানে এসে পৌঁছেছিল বালসাহেবের দেহ। সারা জীবনে সরকারি পদে না বসা, এমনকি সাংসদ, বিধায়কও হননি যিনি, শিবসেনার সেই শীর্ষ নেতার অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। মুম্বইয়ের শিবাজি পার্ক ময়দানে বাবার দেহের সামনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছেলে উদ্ধব। তাঁকে ঘিরে কয়েক লক্ষ মানুষ।
সাত বছর পরে আজ আর এক নভেম্বর সন্ধেয় ভিড়ে ঠাসা সেই শিবাজি পার্কেই গেরুয়া পাঞ্জাবি গায়ে মহারাষ্ট্রের ‘মহা বিকাশ আগাড়ি’ জোটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন উদ্ধব। ঠাকরে পরিবারে এই প্রথম কেউ নেতৃত্ব দেবেন সরকারের। তবে ফারাক একটাই। বালসাহেব নিজেকে সরকারের ‘রিমোট কন্ট্রোল’ হিসেবে তুলে ধরে গর্ব বোধ করতেন। আর উদ্ধবের জোট সরকারের শপথের পরেই প্রশ্ন উঠে গেল, মহারাষ্ট্রে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু কি ঠাকরে পরিবারের ‘মাতুশ্রী’ থেকে শরদ পওয়ারের বাসভবন ‘সিলভার ওকস্’-এ স্থানান্তরিত হয়ে গেল?
শপথ ঘিরে তিন দলের সমর্থকদের উচ্ছ্বাস অবশ্য সে সব প্রশ্নকে ঢেকে দিতে চেয়েছে। বিরাট ময়দানে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শপথ নিয়েছেন উদ্ধব। মাঠ জুড়ে সেনা, এনসিপি ও কংগ্রেসের পতাকা। উদ্ধব ছাড়া শপথ নিয়েছেন ছয় মন্ত্রী। তিন দলের, দু’জন করে। বিধানসভায় শিবসেনার নেতা একনাথ শিন্দে, বালসাহেবের ঘনিষ্ঠ নেতা সুভাষ দেশাই মন্ত্রী হয়েছেন। এনসিপি থেকে শপথ নিয়েছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও পওয়ার পরিবারের ঘনিষ্ঠ নেতা জয়ন্ত পাটিল। শরদ পওয়ার মন্ত্রী করেছেন শিবসেনার দলত্যাগী নেতা এবং এক সময়ে সেখানে নম্বর-টু হিসেবে পরিচিত ছগন ভুজবলকে। সনিয়া গাঁধীর দলের থেকে মন্ত্রী হয়েছেন মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সভাপতি বালসাহেব থোরাট এবং কার্যকরী সভাপতি নিতিন রাউত। শপথের মঞ্চের পাশেই শিবাজির বিরাট মূর্তি। সেখানে প্রণাম করে মরাঠিতে শপথ নেন উদ্ধব ও অন্য মন্ত্রীরা। তবে সেনার সুভাষ দেশাই শপথবাক্য পাঠের সময়ে বালসাহেব ঠাকরের নাম তোলায় এবং কংগ্রেসের বালসাহেব থোরাট সনিয়া গাঁধীর আশীর্বাদ পাওয়ার কথা বলে বসায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। শপথে হাজির ছিলেন অজিত পওয়ার। তাঁকে ফের উপমুখ্যমন্ত্রী করা হতে পারে, এমন জল্পনা রয়েছে। অজিত অবশ্য এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু বলেছেন, ‘‘দল যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।’’
মহারাষ্ট্রে বিজেপি-বিরোধী জোট সরকার কত দিন টিকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আজ ঐক্যের ছবি তুলে ধরতেই সক্রিয় ছিলেন সকলে। সন্ধে ৬টা ৪৩ মিনিটে উদ্ধবের শপথের আগে শিবাজি পার্কে পৌঁছন পওয়ার। তার আগেই শরদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলে টুইট করেন, ‘আজকের দিনে প্রয়াত বালসাহেব আর মা সাহেবের কথা মনে পড়ছে....তাঁরা থাকলে ভাল হতো।’ সুপ্রিয়া লিখেছেন, ‘বালসাহেব আর তাঁর স্ত্রী মীনাতাই ঠাকরে আমাকে মেয়ের মতোই ভালবাসতেন। আমার জীবনে তাঁদের ভূমিকা চিরদিন মনে থাকবে।’ অনেকেই বলছেন, শরদ পওয়ারের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকলেও পওয়ার-কন্যাকে স্নেহ করতেন বালসাহেব। সে জন্যই ২০০৬ সালে রাজ্যসভার ভোটে পওয়ার যখন সুপ্রিয়াকে এনসিপি-র প্রার্থী করেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী দেননি তিনি। আজ উদ্ধবের শপথের দিনে সেই কৃতজ্ঞতাই জানিয়েছেন শরদ-কন্যা।
শপথে হাজির হননি সনিয়া গাঁধী কিংবা তাঁর পরিবারের কেউ। তবে শিবাজি পার্কে দেখা গিয়েছে বালসাহেব ও ইন্দিরা গাঁধীর পাশাপাশি বসে থাকা ছবি। কংগ্রেসের কমল নাথ, কপিল সিব্বলেরা এসেছিলেন। তিক্ততা সরিয়ে রেখে শপথে পৌঁছন বালসাহেবের ভাইপো রাজ ঠাকরে। মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় জানান, তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে আমন্ত্রণ পাননি। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে ঠিক ছিল ১ তারিখে শপথ হবে। পরে ২৮ তারিখেই শপথের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঠিকই করেছেন ওঁরা। অল্প সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারেননি।’’
উদ্ধবের শপথে পৌঁছে যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। আদিত্য ঠাকরেকে আলিঙ্গন করতে দেখা যায় তাঁকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও টুইট করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উদ্ধবকে। লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, উনি যত্ন নিয়ে মহারাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবেন।’ শপথে হাজির হয় অম্বানী পরিবার ও প্রথম সারির শিল্পপতিরা। উদ্ধবের জন্য অনেকটাই স্বস্তি এনে দিয়েছে গাঁধী পরিবার। তাঁকে চিঠি লিখেছেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। সনিয়া লিখেছেন, ‘রাজনীতি যখন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, সেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে জোট হয়েছে মহারাষ্ট্রে।’ শপথের পরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসেন উদ্ধব। সিদ্ধান্ত হয়, কৃষক-সাহায্যে পদক্ষেপ করবে সরকার। শিবাজির রায়গড় দুর্গের জন্য ২০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে।
বলিউডের শিল্প নির্দেশক নিতিন দেশাই জাঁকজমক করা শপথ মঞ্চটি বানিয়েছিলেন দুর্গের আদলে। আগামী পাঁচ বছর সেই দুর্গ ধরে রাখতে পারেন কি না উদ্ধব, সেটাই পরীক্ষা।