এ বারেও ত্রিপুরায় খাপ খুলল না মমতা-অভিষেকের দলের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লড়াই শেষ পর্যন্ত ত্রিমুখীই হল। কিন্তু ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটে কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে গেল তৃণমূল। মোট ৬০ আসনের ত্রিপুরা বিধানসভায় ২৮টিতে প্রার্থী দিয়ে ত্রিপুরায় লড়তে নেমেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। ফল বলছে, সামগ্রিক ভাবে নোটার (নান অফ দ্য অ্যাবভ অর্থাৎ ভোটযন্ত্রে নাম-থাকা উপরের কাউকেই নয়) চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন জোড়াফুল প্রতীকের প্রার্থীরা!
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে ২৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সাকুল্যে ৬,৯৮৯ ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। শতাংশের হিসাবে ০.৩। এ বার ২৮টি আসনে লড়ে প্রাপ্তির ঝুলিতে ২১ হাজারের কিছু বেশি ভোট। শতাংশের হিসেবে প্রায় ০.৯। ২০২১ সালের পুরভোটে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পাওয়া তৃণমূলের এ বারের হাল দেখে বাম-কংগ্রেস শিবির থেকে কটাক্ষ আসছে— বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় বাংলার শাসকদল গোয়ার মতো ‘ভোট কাটার দল’ হয়েও উঠতে পারল না!
তবে এই ফলাফলের জন্য তৃণমূল সম্ভবত তৈরিই ছিল। ত্রিপুরায় প্রচারে গিয়ে মমতা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘‘অভিষেক (বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাকে এখানে প্রচারে আসতে বারণ করেছিল। বলেছিল, দিদি, তুমি গিয়ে আর কী করবে! ওখানে ওরা সব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে।’’ মমতা তবুও প্রচারে গিয়েছিলেন। প্রচারে গিয়েছিলেন অভিষেকও। ঘটনাচক্রে, একটি নির্বাচনী জনসভায় লোক কম হওয়ায় মঞ্চেই খানিক উষ্মাপ্রকাশ করেছিলেন মমতা। ফলে আবহ একটা তৈরিই ছিল। কিন্তু তৃণমূল যে নোটার চেয়েও কম ভোট পাবে, ততটা সম্ভবত দলের অধিকাংশ নেতাই ভাবেননি। তবে তাঁরা আনন্দিত বিজেপির আসনসংখ্যা আগের চেয়ে এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে যাওয়ায়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের নভেম্বরের পুরভোটে আগরতলায় প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল তৃণমূল। আগরতলা পুরনিগমের ৫১টি ওয়ার্ডের ৫১টিতেই বিজেপি জয়ী হলেও শহরের ২৬টি ওয়ার্ডে তৃণমূল ছিল দ্বিতীয় স্থানে। বামেরা দ্বিতীয় হয়েছিল ২৫টিতে।
ওই পুরভোটে ত্রিপুরায় খাতাও খুলেছিল মমতার দল। আমবাসা পুর পরিষদের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। বামেরা রাজ্যে মোট ৩টি ওয়ার্ডে এবং তিপ্রা মথা ১টি ওয়ার্ডে জিতেছিল। কংগ্রেসের ঝুলি ছিল শূন্য। সামগ্রিক ভাবে ২০২১-এর নভেম্বরের পুরভোটে ত্রিপুরার পুরনিগম, পুর পরিষদ ও নগর পঞ্চায়েত মিলে মোট ৩৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২৯টিই রাজ্যের শাসকদল বিজেপি দখল করেছিল। তার মধ্যে ১১২টি তারা আগেই জিতে নিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে এর পরে ২০২২ সালের জুন মাসে চার বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে তৃণমূলের ভোট অনেকটাই কমে গিয়েছিল। চারটি আসনেই তৃণমূলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। এর মধ্যে ছিল আগরতলা পুরসভার অন্তর্গত দু’টি আসন— টাউন বড়দোয়ালি এবং আগরতলা। টাউন বড়দোয়ালিতে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৮৬টি ভোট। আগরতলায় ৮৪২টি। ওই ভোটে বামেদের পিছনে ফেলে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল কংগ্রেস। আগরতলায় জয়ীও হন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থী।
এই পরিস্থিতিতে এ বারের বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ায় গোড়া থেকেই কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ চলে গিয়েছিল তৃণমূল। ফলাফল বলছে, টাউন বড়দোয়ালিতে তাদের ভোট আরও কমে ৬২৩ হয়েছে। আর দেড় বছর আগের পুরনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ‘জোড়াফুল’ আগরতলায় লড়েইনি। রাজধানী শহরের অন্য দু’টি বিধানসভা কেন্দ্র রামনগর এবং বনমালীপুরে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ১,৮০৫ এবং ৪৩০!
বিজেপি, বাম-কংগ্রেস জোট এবং জনজাতি দল তিপ্রা মথার ত্রিমুখী লড়াইয়ের ময়দানে কেন খুঁজেই পাওয়া গেল না জোড়াফুলকে? আলোচনায় উঠে আসছে আরও বেশ কিছু কারণ। ২০২১-এর পুরভোট এমনকি, গত জুনের উপনির্বাচনের তুলনাতেও এ বার তৃণমূলের প্রচার ছিল অনেক নিচু তারে বাঁধা। দলনেত্রী মমতা এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক প্রচারে গেলে সাধারণত তাঁদের অধিকাংশ কর্মসূচিতে ভিড় হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জোড়াফুল প্রার্থীদের প্রচারে হাতেগোনা কর্মী-সমর্থককে দেখা গিয়েছে।
ওয়াকিবহালরা বলছেন, পুরভোটে দলের দায়িত্বে থাকা সুবল ভৌমিকের বিজেপিতে যোগদান বা বাপ্টু চক্রবর্তীর মতো নতুন প্রজন্মের নেতার কংগ্রেসে ফিরে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে ভোটে। বিশেষত বাঙালি অধ্যুষিত ৪০টি আসনে। অন্য দিকে, জনজাতি এলাকার ২০টি আসনে কখনওই তেমন সমর্থন ছিল না তৃণমূলের। প্রাথমিক ভাবে জনজাতি দল তিপ্রার সঙ্গে সমঝোতা নিয়ে জল্পনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি। মমতার শাসনে বাংলার ‘মডেল’কে সামনে রেখেই ত্রিপুরায় তৃণমূলের লড়াই তাই শেষ পর্যন্ত নিষ্ফলই হয়ে গিয়েছে।