বর-কনের সিংহাসনের মাঝে তাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন অতিথি অভ্যাগতরা। গলায় সুদৃশ্য বকলসে সেজে নবদম্পতির মাঝে সব আগ্রহের কেন্দ্র হয়েছিল সে-ই! নাম তার স্পার্কি। কনের আদরের পোষ্য। তবে এ আদর খুব সহজে জোটেনি। বরং তাকে বন্ধুত্ব ও স্নেহের পথে ফেরাতে কম কালঘাম ছোটেনি তার অভিভাবকের।
যখন প্রথম দেখা হয় দু’জনের, তখন তরুণীকে দেখেই ভয়ে খাঁচায় জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল স্পার্কি। বেঙ্গালুরুর একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে খাঁচাবন্দি জীবন কাটছিল তার। তখন সে ছিল গবেষণার ‘গিনিপিগ’। ওষুধ প্রস্তুতকারী ও কীটনাশক সংস্থাদের অধীনে থাকা শত শত বিগলের এক জন।
গবেষণার ল্যাবে মোটেও ভাল লাগত না স্পার্কির। খাওয়া, ঘুম, মল-মূত্র ত্যাগ সব ওই ছোট্ট খাঁচায়। ছোট্ট স্পার্কি ভয় পেত খুব। দিনের শেষে একটু আদরও জুটত না। সে দেখত, পরীক্ষায় সাড়া দিতে না পারলে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে বন্ধুরা! কেউ কেউ মারা গেলে তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিষ্ঠুর ভাবে। তার জায়গায় চলে আসছে অন্য কোনও বিগল।
ছোট্ট স্পার্কি বুঝত না, কেন বার বার তাদেরই তুলে আনা হয় গবেষণার ঘরে! আসলে ইঁদুর ও গিনিপিগদের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয় বিগলদেরই। এই প্রজাতির কুকুর আকারে বড় ও শক্তিশালী হওয়ায় এদের সহ্যশক্তি বেশি বলে হয়। তাই গবেষকদের কাছে ইঁদুর-গিনিপিগে সাফল্য মেলার পর বিগলরাই হয়ে ওঠে প্রথম পছন্দ।
বিগল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেশ কিছু আইনি ফরমান আছে। স্বাস্থ্যকর খাঁচা, তাদের ঠিকঠাক দেখভাল— নিয়ম আছে অনেক কিছুরই। তবে সে সব কতটা মেনে চলা হয় তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মূল গোল বাঁধে গবেষণার পরে। এই সব বিগলদের পুনর্বাসন হত না আগে। গবেষণার পর এই বিগলগুলি ভয়ঙ্কর জীবনযাপন করত। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষার পর অসুস্থ কুকুরদের মেরেও ফেলা হত।
ছোট থেকে আর পাঁচটা সাধারণ কুকুরের মতো প্রকৃতি ও মানুষের ছত্রছায়ায় বড় না হওয়ায় ল্যাব থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই অসুবিধা হত এই বিগলদর। তাদের দুর্দশার কথা বুঝতে পেরে ২০১২ সালে এগিয়ে আসেন বেঙ্গালুরুর তরুণী চিন্থানা গোপীনাথ ও অবন্তী আগরওয়াল।
কমপ্যাশন আনলিমিটেড প্লাস অ্যাকশন (কুপা)-এর মাধ্যমে একটি বিগলকে তিনি দত্তক নেন। তখনও গবেষণায় প্রয়োজনীয় কুকুরদের পুনর্বাসন নিয়ে তেমন কড়া কোনও আইন নেই। আইন এল ২০১৫-তে। আইন করে জানানো হল, একটি প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পরে বা পরীক্ষায় ব্যবহৃত কুকুরের বয়স তিন বছরের মধ্যে হলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তাই ২০১৬-তে বেঙ্গালুরুর ওই গবেষণাগারটি বন্ধ হয়ে গেলে প্রায় ২৫০টি বিগল আশ্রয় হারায়। এ দিকে সিইউপিএ খবর পায়, ২০১২-তে চিন্থানার দত্তক নেওয়া বিগলটি বংশবৃদ্ধি করেছে। বিগলের অভিভাবক হিসেবে চিন্থানা তত দিনে সফল। তাঁর প্রিয় পোষ্য স্পার্কি বেশ চনমনে ও মিশুকে হয়ে উঠেছে।
তাই চিন্থানারই শরণ নেয় সিইউপিএ। কী ভাবে এই ২৫০ বিগলের পুনর্বাসন করানো সম্ভব হয় তা নিয়ে চলে আলোচনা। অবশেষে যোগাযোগ হয় অবন্তীর সঙ্গেও। এই বিগলদের পাশে দাঁড়াতে তাঁরা দু’জন একটি অসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রেগলস অব ইন্ডিয়া (ফোই) গঠন করেন।
চিন্থানার মতে, পরীক্ষাগার থেকে আনার পর এই বিগলগুলি খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। সূর্যের আলো, মানুষের স্পর্শ, আদর কোনওটাতেই খুব একটা অভ্যস্ত হয় না এরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের প্রতি আস্থা অর্জন করতে পারে। তাই এদের দেখভালের জন্য অভিভাবকদেরও ঠিকঠাক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।
এই প্রশিক্ষণের কাজটাও করে ফোই। চিন্থানা ও অবন্তীয় কথায়, এই বিগলগুলিকে ক্ষণিকের জন্য খুশি ও চনমনে দেখলেও আমরা চট করে তাদের সঙ্গে খেলাধূলা করি না। আগে একটু একটু করে চিবুকে আদর, মাথায় হাত বোলানোর মাধ্যম মানুষ ও বিগলদের মধ্যে মিলমিশের রসায়ন তৈরি করা হয়।
ফোই থেকে কেউ কোনও বিগল দত্তক নিতে চাইলে সেই অভিভাবকের যত্ন ও ধৈর্যের উপর কড়া নজর রাখে তারা। কয়েক মাস ধরে খতিয়ে দেখা হয়, দত্তক নেওয়ার পর বিগলটির মানসিক ও শারীরিক অবস্থা। বিগলকে সামলাতে না পারলে তাকে ফিরিয়ে আনে ফোই। প্রয়োজনে অভিভাবককে প্রশিক্ষিতও করে তোলে তারা।
এখনও অবধি ৪৬৫টি বিগলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্থান হয়ে উঠেছে ফোই। ‘মা’য়ের বিয়েতে ‘নিতকনে’ স্পার্কি-ই সেই আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রমাণ।