রঞ্জন গগৈ। ফাইল চিত্র।
শুধু সরকারি দুর্নীতির অনুসন্ধান করা সংবাদিক বা রাহুল গাঁধীর মতো বিরোধী রাজনীতিকরাই নন, ২০১৯-এ পেগাসাসের নিশানায় এসেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনা মহিলা ও তাঁর পরিবারও। এমনই অভিযোগ উঠে আসছে এ বার। আড়ি পাতার জন্য নিশানা করা হয় ওই মহিলা ও তাঁর পরিবারের মোট ১১টি ফোন নম্বর। যার মধ্যে ৩টি নম্বর ওই মহিলার। ৫টি তাঁর স্বামীর। বাকি ৩টি মহিলার দুই দেওরের।
অভিযোগ, ভারতের ‘অজ্ঞাত’ কোনও সংস্থা ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও-র তৈরি ফোনে আড়ি পাতার ‘স্পাইওয়্যার’ পেগাসাস দিয়ে তাঁদের ফোন নম্বরগুলিকে নিশানা করেছিল। যদিও তাঁদের ফোনে বাস্তবে আড়ি পাতা হয়েছে কি না, তার প্রমাণ মেলা দুষ্কর। কারণ এনএসও-র বরাবরের দাবি, তারা শুধু সরকারি সংস্থাকেই ওই ‘স্পাইওয়্যার’ জোগায়। সে ক্ষেত্রে মোদী সরকারের কোনও সংস্থা এই আড়ি পাতা বা তাঁর চেষ্টার কথা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জানাবে, সে আশা দূর অস্ত্। আড়ি পাতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার জবাবে বৈদ্যুতিন ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রকের দাবি, এ সব অভিযোগ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’। মন্ত্রকের বক্তব্য, ‘পেগাসাসের সঙ্গে সরকারের যোগ’ নিয়ে ওঠা অভিযোগের কোনও ‘জোরালো ভিত্তি বা সত্যতা নেই’।
শীর্ষ আদালতের হাতে তখন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মামলা, সরকার ও শাসক শিবিরের অনেক কিছু নির্ভর করছে যেগুলির উপরে। অযোধ্যার বিতর্কিত জমি নিয়ে মামলার রায় বেরোবে কয়েক মাস পরে, এমন এক সময়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন সুপ্রিম কোর্টের কর্মী ওই মহিলা। যার জেরে ২০১৮-র ডিসেম্বরে চাকরি খোয়ান তিনি। ২০১৯-এর ২০ এপ্রিল ওই মহিলা সুপ্রিম কোর্টের ২২ জন বিচারপতির কাছে হলফনামায় তাঁর নিগ্রহের কথা জানান। ফ্রান্সের যে অলাভজনক সংস্থা আড়ি পাতার বিষয়টি সামনে এনেছে, সেই ‘ফরবিডেন স্টোরিজ়’ জানাচ্ছে, হলফনামা দেওয়ার কয়েক দিন পরেই পেগাসাসের নিশানা করা হয় ওই মহিলা ও পরিবারের ফোন নম্বরগুলি। ‘ফরবিডেন স্টোরিজ়’ এই কাজ করছে ১৬টি আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্টনারের সঙ্গে। সাহায্য করছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের টেকনিক্যাল টিম।
মূল যে কয়েকটি বিষয় এতে উঠে আসছে, তা হল, ওই মহিলা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ফোনে যদি আড়া পাতা হয়ে থাকে, তবে ওই যৌন নিগ্রহের অভিযোগ নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে তাঁরা যে শলা-পরামর্শ করেছিলেন, সে সবও ফাঁস হয়ে গিয়েছিল! কাদের কাছে?
উত্তর নেই।
মহিলার অভিযোগ শুনতে গড়া হয়েছিল আদালতের ইন-হাউস কমিটি। বিচার হয় রুদ্ধদ্বারে। বিচারপতি গগৈ নিজেই ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিচারের প্রধান দায়িত্বে। ওই মহিলার অভিযোগ ‘সারবত্তাহীন’ বলে চিহ্নিত করা করা হয়। গগৈ নিজে বলেন, “এটা দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরে আঘাত।” এই ঘটনার সঙ্গে আপাত সম্পর্কহীন ভাবে মহিলার দিল্লি পুলিশে কর্মরত স্বামী ও দেওর সাসপেন্ড হন ফৌজদারি অভিযোগে। পরে অবশ্য সে সব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হয়নি।
তথ্য-সুরক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ওই মহিলার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর অন্তত কয়েক মাস ধরে চলেছে তাঁদের ফোনগুলিকে নিশানা করার কাজ। এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, ভারতে একটি মাত্র বিষয়ের সঙ্গে জড়িত এতগুলি ফোন নম্বরকে নিশানা করার এটিই একমাত্র ঘটনা। এবং এটি ছিল এমন একটি বিষয়, যার সঙ্গে জননিরাপত্তা বা জাতীয় সুরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। প্রশ্নটা ছিল এক নারীর যৌন নিগ্রহের অভিযোগের সুবিচার পাওয়া নিয়ে।