প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে ফারাক থাকতেই পারে। ফারাকের অর্থ বৈষম্য নয়, বরং তা গণতন্ত্রের প্রতীক। অধিকাংশ দেশই এখন এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ফারাককে স্বীকৃতি দেওয়ার পথেই হাঁটছে। মূলত এই যুক্তিতেই ২১-তম আইন কমিশনের মত ছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত নয়। তার প্রয়োজনও নেই।
সম্প্রতি ২২-তম আইন কমিশন নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে সওয়াল করেছেন। কংগ্রেস, সিপিএম-সহ একাধিক দল ২১-তম আইন কমিশনের ২০১৮ সালের রিপোর্টকেই হাতিয়ার করে প্রশ্ন তুলেছে, এক বার যখন আইন কমিশন এ বিষয়ে মত দিয়েছে, তখন ফের তা নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হচ্ছে কেন!
কী বলেছিল ২১-তম আইন কমিশন?
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলবীর সিংহ চৌহানের নেতৃত্বাধীন ২১-তম আইন কমিশনের মত ছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকারের মতো পারিবারিক বিষয়ে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান, পার্সি, জৈন সকলের একই আইন চালু করার প্রয়োজন নেই। পারিবারিক আইনে সংস্কার নিয়ে কমিশনের বক্তব্য ছিল, “সংঘাতের সমাধান ফারাক মুছে ফেলা নয়। অধিকাংশ দেশ এখন ফারাককে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। ফারাক থাকাটাই মজবুত গণতন্ত্রের প্রতীক। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এখন কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রয়োজনও নেই। তার বদলে যেখানে বৈষম্য রয়েছে, সেগুলো দূর করা উচিত।”
বৈষম্য দূর করতে ২১-তম আইন কমিশনের সুপারিশ ছিল, সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য বিয়ের নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক করা হোক। বিয়ের ন্যূনতম বয়স সকলের জন্য এক হোক। বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, দম্পতির মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা না থাকাই বিবাহবিচ্ছেদের একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। ধর্ম বদলে দ্বিতীয় বা বহুবিবাহ করার সুযোগ দেওয়া বন্ধ করা হোক। যে কোনও লিঙ্গের মানুষই সন্তান দত্তক নিতে পারবেন, কোনও একা পুরুষ যাতে কন্যা সন্তানকে দত্তক নিতে পারে, তার আইনি বন্দোবস্ত করা হোক।
অধিকাংশ বিরোধী দলই মনে করছে, ২১-তম আইন কমিশনের এই রিপোর্টের পরে নতুন করে ২২-তম আইন কমিশনের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন ছিল না। মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব থেকে নজর ঘোরাতে তা নিয়ে বিতর্ক খাড়া করতে চাইছে। বিজেপি নেতারা মুসলিমদের বহুবিবাহের সুযোগ বন্ধ করা হবে বলে প্রচার করছে। বাস্তবে এই সব বিষয় সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করে তাঁরা রাস্তায় নামবেন না। তাঁদের মতামত আইন কমিশনের কাছেই জানাবেন। যদিও তাঁদের আপত্তি গ্রাহ্য হবে না সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। বোর্ডের সদস্য ও জমিয়ত-উলেমা-ই-হিন্দের প্রধান মৌলানা আর্শাদ মাদানির বক্তব্য, মুসলিমদের নিজের ধর্মবিশ্বাস মেনে চলা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার আজ মনে করিয়েছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে শিখদের ভিন্ন মত রয়েছে। তা অগ্রাহ্য করা যায় না। পওয়ারের প্রশ্ন, মুসলিম মহিলাদের প্রতি বৈষম্য হয় বলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি দরকার, বিজেপি এমন সওয়াল করছে। তা হলে বিধানসভা, লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল আনা হচ্ছে না কেন?
শিখদের আপত্তির কথা স্পষ্ট করে শিরোমণি অকালি দলের নেতা দলজিৎ সিংহ চিমা বলেন, “এই অভিন্ন বিধি দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে নয়। ২১-তম আইন কমিশন বলে দিয়েছিল, এর দরকার নেই। এতে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে। দেশে অস্থিরতা, উত্তেজনা বাড়বে।” একই কথা বলেছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লাও।