পদ্মা-মেঘনার বুকে এখন আষাঢ়ের কালো মেঘের আনাগোনা। এই ভরা বর্ষায় ঢাকায় গিয়ে ও-দেশের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে ভারী ভারী আলোচনা তো হবেই, কিন্তু বরিশাল বা ভোলার ইলিশের স্বাদ নিতে যেন ভুল না-হয় নতুন বিদেশমন্ত্রীকে সে পরামর্শই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নয়াদিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন আজ বলেন, “বাংলাদেশ সফরের জন্য সুষমা নিরলস প্রস্তুতি নিয়েছেন। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসাবেই তিনি আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।” কিন্তু পাতের ইলিশে যে কাঁটার ঝকমারিও কম নয়, সফরের প্রস্তুতির সময়ে তা বিলক্ষণ অনুধাবন করেছেন সুষমা। কারণ শুধু তো মমতা নন, ঢাকাকে দেওয়া আগের সরকারের প্রতিশ্রুতি পালন করতে না-পারার পিছনে সুষমার নিজের দল বিজেপি-র পশ্চিমবঙ্গ ও অসম শাখার কড়া বিরোধিতাও সমান দায়ী।
সন্ধ্যায় ঢাকার বিমান ধরার আগে মমতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন বিদেশমন্ত্রী। নেহাতই সৌজন্যের ফোনালাপ। সাংসদ হিসাবে দু’জনের পরিচয় দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন বিষয়ে কখনও একসঙ্গে, কখনও পরস্পর-বিরোধী বিতর্কে অংশ নিয়েছেন দু’জনে। এনডিএ জমানায় বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সতীর্থও ছিলেন মমতা-সুষমা। অনেকে মনে করছেন, এই সফরের আগে মমতার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সুষমা এই বার্তাই দিলেন, পশ্চিমবঙ্গকে এড়িয়ে বাংলাদেশ নিয়ে নতুন কোনও অবস্থান নরেন্দ্র মোদীর সরকার নেবে না।
ঢাকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মসৃণ ভাবে এগিয়ে চলায় সবচেয়ে বড় বাধা দু’টি বকেয়া বিষয় তিস্তার জলবণ্টন ও স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত করা। এই দু’টি বিষয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তি রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তাঁকে ফোন করে এ বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও শুরু করে দিলেন সুষমা। তবে ওয়াকিবহাল সূত্রের খবর, ফোনালাপে তিস্তা বা স্থলসীমান্ত চুক্তিতে রাজ্যের আপত্তির বিষয়টি সুষমা যেমন তোলেননি, মমতাও সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে নতুন বিদেশমন্ত্রী যেন এই ভরা বর্ষায় বাংলাদেশে গিয়ে ইলিশ খেতে না-ভোলেন, সে বিষয়টি বিশেষ করে মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা।
স্থলসীমান্ত চুক্তির জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। গত লোকসভায় তৃণমূলের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও সমানে বিরোধিতা করায় তা হতে পারেনি। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ ও অসম শাখাই মূলত তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। সেই বিজেপি ভোটে জিতে দিল্লির গদিতে বসার পরে মুখে যাই বলুক, আস্থার কিছুটা অভাব অবশ্যই রয়েছে ঢাকার। ভোটের প্রচারে মোদী ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বিতাড়নের যে জিগির তুলেছিলেন, তা-ও কপালে ভাঁজ ফেলেছিল ঢাকার।
কূটনীতিকরা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ এড়িয়ে জাপান চলে গিয়ে সেই অনাস্থার বার্তাই দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোদীও তা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন। সে জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আসা হাসিনার প্রতিনিধি বাংলাদেশ সংসদের স্পিকার শিরিন শরমিন চৌধুরীকে তিনি বলেন, জঙ্গি উচ্ছেদ ও নিরাপত্তার নানা ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ভারতকে যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, দিল্লি তাতে কৃতজ্ঞ। আগের সরকার বাংলাদেশকে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, নতুন সরকার তার সব ক’টি বাস্তবায়নে আগ্রহী। মোদী বলেন, তাঁর সরকারের বিদেশনীতিতে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব থাকবে।
কূটনীতিকরা বলছেন, দিল্লির নতুন সরকারের তরফে ঢাকার নেতৃত্বকে সেই আস্থার বার্তা দিতেই বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তাঁর প্রথম একক বিদেশ সফরের জন্য বাংলাদেশকে বেছেছেন। সুষমার হাত দিয়ে শেখ হাসিনার জন্য দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ বার্তাও পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আগামী দু’দিনে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গেও আলোচনায় বসবেন সুষমা। তিস্তা এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি রূপায়ণে দিল্লির আন্তরিকতার কথা আরও এক বার বলবেন সুষমা।
আজ রাতে ঢাকায় পৌঁছেছেন সুষমা। বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ভারতের নতুন সরকারের বিদেশমন্ত্রীর এই সফরকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে ঢাকা। তাঁর আতিথ্যের খুঁটিনাটি দেখভাল করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং।
বিদেশ মন্ত্রকের সূত্র জানাচ্ছে, ফিরতি বিমানে ওঠার আগে শুক্রবার সকালে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সুষমা দেখা করতে পারেন। গত বছর রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়েও যাননি খালেদা। ঘটনায় প্রণববাবু যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, বিএনপি-র সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কেও তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। ঢাকার রাজনৈতিক সূত্রের খবর, খালেদাই এখন সে সম্পর্ক মেরামতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সুষমাও বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে সময় দিয়েছেন।