সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার সময়ে সমলিঙ্গে বিয়ে মামলার মামলাকারীরা। —নিজস্ব চিত্র।
‘একঝাঁক ইচ্ছেডানা, যাদের আজ উড়তে মানা, মিলবেই তাদের অবাধ স্বাধীনতা!’ ‘পরশপাথর’ ব্যান্ডের সেই ফেলে আসা গানটাই যেন আজ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
‘‘আজ না হলে আগামিকাল হবে। আমাদের অধিকারের জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কোনও দেশেই সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী বা ছক ভাঙা যৌন রুচির মানুষরা বিনা লড়াইয়ে অধিকার পাননি।’’ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে বলছিলেন সুপ্রিয় চক্রবর্তী। সঙ্গে তাঁর ‘জীবনসঙ্গী’ অভয় ডাং। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে দু’জনেই ‘প্রচণ্ড হতাশ’। কিন্তু আঁধার কেটে যাওয়ার আশাও ছাড়ছেন না তাঁরা।
প্রায় দু’বছর আগে ধুমধাম করেই হায়দরাবাদে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের সুপ্রিয়র সঙ্গে অভয় ডাংয়ের ‘বিয়ে’ হয়েছিল। দু’জনের পরিবারের উপস্থিতিতে। সমপ্রেমের সেই বিয়ের আইনি স্বীকৃতির দাবিতে তাঁদের মতো আরও অনেকের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সুপ্রিয় ও অভয়। এপ্রিল-মে মাসে শুনানির সময় প্রায়ই হাজির থাকতেন। মঙ্গলবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনতেও হায়দরাবাদ থেকে চলে এসেছিলেন দিল্লিতে। সুপ্রিম কোর্টে ঢোকার সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই আইনজীবী মেনকা গুরুস্বামী ও অরুন্ধতী কাটজু। যাঁরা আদালতের আঙিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনেও একই লড়াই লড়ছেন। আজ বিশেষ দিনে অরুন্ধতী রামধনু রঙের পাড়ওয়ালা শাড়ি পরেছিলেন।
আশা পূরণ হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট সমপ্রেমের বিয়েকে আইনি স্বীকৃতি দিতে চায়নি। অরুন্ধতী বলেন, ‘‘আমরা খুবই হতাশ। যদিও শীর্ষ আদালত বলেছে, ভিন্ন যৌন রুচির মানুষের সম্পর্কে জড়ানোর অধিকার রয়েছে, কিন্তু আইনি স্বীকৃতি দেয়নি আদালত।’’ যে সব সমপ্রেমী যুগলের সামাজিক বিয়ে হয়ে গিয়েছে বা যাঁরা একসঙ্গে দম্পতির মতো থাকছেন, তাঁদের জন্যও কোনও সুরাহা দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিয়-অভয় রীতিমতো টোপর পরে, সব রীতি মেনে বিয়ে করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হবে না? সুপ্রিয়র উত্তর, ‘‘আমরা সামাজিক ভাবে কোনও অসুবিধার মুখোমুখি হইনি। কিন্তু আমাদের কোনও আইনি
অধিকারও নেই।’’
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আবেদনকারীরা বলছেন, পাঁচ বিচারপতির রায়ে ছক ভাঙা যৌন রুচির মানুষদের জন্য অনেক কথা রয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ‘এলজিবিটিকিউ’ সম্প্রদায় যাতে বৈষম্য, হেনস্থার মুখে না পড়ে, তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে। আইনি স্বীকৃতির প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্ট সংসদের উপরে ছেড়ে দিয়েছে। এ বার সেই সাংসদদের কাছে দরবার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, যে সংসদে সংখ্যাগুরুবাদে বিশ্বাসী বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সেখান থেকে কি যৌন সংখ্যালঘুদের জন্য কিছু আশা করা যায়?
এক সময় রাজনাথ সিংহের মতো বিজেপির প্রবীণ নেতা সমকামিতাকে ‘অস্বাভাবিক’ ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। প্রয়াত অরুণ জেটলি থেকে পীযূষ গয়ালের মতো নেতারা অবশ্য কিছুটা উদার মনোভাব নিয়েছেন। এমনকি যোগী আদিত্যনাথও সমকামিতা আইনি অপরাধ হতে পারে না বলে মত দেন। কিন্তু হালে বিজেপি সাংসদ, বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী সমপ্রেমের বিয়ে আইনি স্বীকৃতি পেলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেছেন। আজ বিজেপি নেতা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এ সব বিদেশি সংস্কৃতি। ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ। ভারতে বিয়ে হয় সন্তান উৎপাদনের জন্য, বংশবৃদ্ধির জন্য। যৌনাচার বা যৌন সুখের জন্য নয়।’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা নন্দীর মতে, কংগ্রেস-সহ বিরোধীশাসিত রাজ্য সরকারগুলির সামনে পদক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে। সমপ্রেমী যুগলের এক জন যাতে অন্য জনের চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, রাজ্যগুলি এই আইন আনতে পারে। চাকরির ক্ষেত্রে যাতে বৈষম্য না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের মন্তব্য, ‘‘কংগ্রেস বরাবরই নাগরিকদের অধিকার, স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক বা বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়ায় সকলকে নিয়ে চলা, ভেদাভেদ না করায় বিশ্বাসী। কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের রায় খতিয়ে দেখে বিশদে দলের অবস্থান জানাবে।’’
সমপ্রেমের বিয়ের অধিকারের পক্ষে আন্দোলনকারীরা তাই মনে করছেন, সামনে এখনও দীর্ঘ লড়াই বাকি। সুপ্রিয় বলছিলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে আমরা গর্বিত যে এই লড়াইটা লড়েছিলাম। এখন হার মানতে হল। কিন্তু এই মামলার জন্যই এই বিষয়টা নিয়ে খাবার টেবিলে আলোচনা হয়েছে। লোকে এই সম্প্রদায় নিয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে।’’ সুপ্রিয় বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজনে ‘ইভেন্ট প্ল্যানার’ হিসেবেই কাজ করেন। এখন বিয়ের ভরা মরসুম। হায়দরাবাদে ফিরেই অন্যদের বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে তাঁকে। নিজের বিয়ের আইনি স্বীকৃতিও এক দিন না এক দিন মিলবে, এই আশা ছাড়ছেন না সুপ্রিয়—‘‘আমরা আশায় থাকব একদিন বিয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সমতা আসবে।’’
‘এক দিন দেখব আলো, আঁধারের শেষ যেখানে, আসবেই দখিন বাতাস, আকাশের বার্তা নিয়ে’—সুপ্রিয়দের কথায় ইচ্ছেডানার আশার সুর ভেসে বেড়াচ্ছে।