—প্রতীকী ছবি।
জেল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে আগের বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের হাজারো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ১৯৯৫-এ একটি সত্যানুসন্ধানী কমিশন গড়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই কমিশনের নেতৃত্বে রেখেছিলেন বর্ণবৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনের আর এক নেতা আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুকে। ১৯৯৮-তে সেই কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছিল, সর্বাংশেই তা ছিল ঐতিহাসিক। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের অন্যতম সদস্য বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউল পৃথক রায়ে কাশ্মীরে ১৯৮০ থেকে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে তেমনই একটি সত্যানুসন্ধানী কমিশন (ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যারা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তির বাইরের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে ওটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি সমীক্ষা করে দেখে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে একটি রিপোর্ট দেবে। সঙ্গে দোষীদের শাস্তিরও সুপারিশ করবে।
বিচারপতি কউল তাঁর রায়ে মন্তব্য করেছেন, “দশকের পর দশক ধরে ভূস্বর্গের মানুষ বিভিন্ন পক্ষের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের শিকার, ঐতিহাসিক বোঝা বহন করে চলেছেন তাঁরা।” ১৯৮০-র উল্লেখ করে তিনি বলেন, জঙ্গি সমস্যার কারণে যুগ যুগ ধরে উপত্যকায় বসবাস করা এক সম্প্রদায়ের মানুষকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। সেই জঙ্গি সমস্যা যখন দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল, তখন সেখানে সেনা মোতায়েন করতে হল। বিচারপতি বলেন, যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সেনাদের কাজ নয়, তারা রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তেই অভ্যস্ত, সেই সেনাদের মোতায়েনে কাশ্মীরে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হল, আজও যার মূল্য চোকাতে হচ্ছে সেখানে বসবাসকারী পুরুষ, মহিলা এমনকি শিশুদেরও। বিচারপতি জানিয়েছেন, কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের কথাবার্তা, আচরণে তিনি কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসা আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছেন। এগিয়ে যেতে চাইলে সেই ক্ষতপূরণ করাটা প্রয়োজন। কাশ্মীরের তছনছ হয়ে যাওয়া সামাজিক পরিমণ্ডলটি পুনর্গঠন করতে হবে। বিচারপতি কউলের কথায়, এমনকি দেশভাগের সময়েও কাশ্মীরের অসাম্প্রদায়িক সামাজিক পরিমণ্ডলটি অটুট ছিল, যা দেখে সেই সময়ে মোহনদাস গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন— ‘মানবিকতার আশার আলো কাশ্মীর’।
বিচারপতি কউল বলেন, কাশ্মীরে কান পাতলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র অভিযোগ শোনা যায়, যা সত্যই ঘটেছিল না পল্লবিত হয়ে সত্যে পরিণত হয়েছে তা খুঁজে দেখাটা জরুরি। সত্যানুসন্ধানী কমিশন ১৯৮০-র পর থেকে রাষ্ট্রশক্তি ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করবে এবং তাদের শাস্তির বিধানও দেবে। বিচারপতি বলেন, জনস্মৃতি বিলীন হওয়ার আগেই এই কাজ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিশনকে কাজ শেষ করতে হবে। তাঁর মতে, এ ভাবেই ভূস্বর্গের বাসিন্দাদের মনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতস্থান সারিয়ে তোলা সম্ভব।
বিচারপতি যে সত্যানুসন্ধানী কমিশনের সুপারিশ করেছেন, তার এক্তিয়ার সাধারণ তদন্ত কমিটির চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী। বিচারপতি কউল জানিয়েছেন, এই কমিশন কোনও ভাবেই ফৌজদারি আদালত হবে না। তাদের কাজ হবে মূলত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার উৎসে পৌঁছনো। আলোচনা ও ভিন্নমতের সমাহারকে গ্রহণ করেই এগোতে হবে কমিশনের সদস্যদের। উগান্ডা (১৯৭৪) ও কেনিয়া (২০০৯)-য় গণহত্যার তদন্তে এমন ট্রুথ কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগের তদন্তে কাজ করে রিপোর্ট দিয়েছে সত্যানুসন্ধানী কমিশন।