পাথর ছুড়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে অমৃতসর মেলের জানলা। শনিবার বিহারের মোকামা স্টেশনে।—নিজস্ব চিত্র।
প্রথমে এসি থ্রি টিয়ার কামরায় উঠে বসতে চেয়ে জোরজুলুম, বাধা পেয়ে ব্যাগ থেকে ছুরি বের করা, শেষে ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে রেললাইনের পাথর ছুড়ে কামরার একের পর এক জানলার কাচ গুঁড়িয়ে দেওয়া। শনিবার সকালে হাওড়ামুখী অমৃতসর মেলে এই তাণ্ডব কোনও দাগি আসামিদের নয়। যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা বিহারের একদল স্কুলছাত্র! এমনকী মহিলা যাত্রীদের গয়না ছিনতাইয়ের চেষ্টার অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। যাত্রীদের ক্ষোভ, প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই তাণ্ডব চললেও রেল পুলিশ বা আরপিএফ জওয়ানদের দেখা মেলেনি। তবে ওই কামরার যাত্রী এক সেনা জওয়ানের তৎপরতায় ছুরি-হাতে গুণধরটিকে পাকড়াও করা গিয়েছে।
ইস্ট-সেন্ট্রাল রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক অরবিন্দ রজক বলেন, “এখন বিহারে ম্যাট্রিক পরীক্ষা চলছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, এই ঘটনা ঘটিয়েছে ম্যাট্রিক (বিহার বোর্ডের মাধ্যমিক) পরীক্ষার্থী কিছু ছাত্র। স্থানীয় রেল পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে।” রেল পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন পটনা থেকে মোকামা স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় ওই ছাত্ররা অমৃতসর মেলের এসি থ্রি টিয়ার বি১ কামরাটিতে উঠে পড়ে। প্রত্যেকের পিঠে ব্যাগ ছিল। যাত্রীদের অভিযোগ, কামরায় উঠেই তারা নিজেদের ‘স্টুডেন্ট’ পরিচয় দিয়ে জবরদস্তি সিটে বসতে চায়। যাত্রীরা আপত্তি করলে শুরু হয় গালিগালাজ। অভিযোগ, এর পরেই কয়েক জন মহিলার সোনার গয়না কেড়ে নিতে যায় ওই পড়ুয়ারা। তাঁরা চিৎকার করে ওঠেন। বাধা দিতে গিয়ে ছাত্রদের হাতে মার খান এক যাত্রী। এই সময়ে কামরার অন্য যাত্রীরা রুখে দাঁড়ান। এবং তখনই স্কুলব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে ছুরি। কামরার যাত্রী সেনা জওয়ানটি ওই ছেলেটিকে জাপটে ধরে ফেলেন। বেগতিক বুঝে ছাত্রদের দল চেন টেনে নেমে পড়ে। জায়গাটা কিউল স্টেশনের আগে।
শুরু হয় আতঙ্কের দ্বিতীয় পর্ব। রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে ওই কামরার জানলা লক্ষ করে ছুড়তে শুরু করে পড়ুয়ারা। আতঙ্কে কাঁদতে থাকেন মহিলা ও শিশুরা। প্রাণ বাঁচতে ‘আপার বার্থ’-এ আশ্রয় নেন অনেকে। সকাল তখন প্রায় সাড়ে ১০টা। বিনা বাধায় চলতে থাকে তাণ্ডব। এই গোটা সময়টায় কোনও রেলকর্মীর দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ। হাওড়ায় নেমে ওই কামরার যাত্রী আলো মজুমদার বলেন, “দিনের বেলায় ট্রেনের মধ্যে এত অসহায় কোনও দিন লাগেনি। এই রকম আক্রমণ! আরপিএফ বা রেল পুলিশের কথা বাদই দিন, এক জন টিকিট পরীক্ষক পর্যন্ত ছিলেন না!”
যদিও রেল পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেছেন, “ওই কামরার টিকিট পরীক্ষক আসানসোলে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। আমরা সেই অভিযোগপত্র যে স্টেশন এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।” যাত্রীরা কিন্তু বলছেন, সব চুকে যাওয়ার পর রেল পুলিশের যে দলটি ঘটনাস্থলে কামরায় তদন্ত করতে এসেছিল, তারা লিখিত অভিযোগ নিতেই চায়নি। কিউল স্টেশনে পৌঁছনোর পর জিআরপি থানা তাঁদের অভিযোগ নেয়। যে ছাত্রটি ছুরি বের করেছিল বলে অভিযোগ, তাকে ওই স্টেশনেই রেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সঙ্গীরা তাণ্ডব চালালেও সেনা জওয়ানের হাত ছাড়িয়ে সে পালাতে পারেনি। তবে ছাত্রটিকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে কি না, স্পষ্ট জানা যায়নি।
অমৃতসর মেল এ দিন বিকেলে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলে যাত্রীরা ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বিক্ষোভ দেখান। বি১ কামরার সামনে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ জানলার কাচ ভাঙা। কাচের টুকরোয় ভরে রয়েছে কামরার ভেতরটা। যাত্রীদের ব্যাগপত্রের উপরেও কাচ পড়ে রয়েছে। এখানে-ওখানে ছড়ানো বড় বড় পাথরের টুকরো। ইয়াসিন হাসিন নামে এক যাত্রী ভয়ার্ত চোখে বললেন, “এই পাথর কোনও যাত্রীর মাথায় লাগলে তাঁকে কি বাঁচানো যেত? আমাদের তা হলে নিরাপত্তা কোথায়?”
একই কথা দীপক সরকার নামে আর এক যাত্রীরও। তিনি বলেন, “প্রতি বছর রেল বাজেটে যাত্রী নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বলে শুনি। আজ দেখলাম যাত্রী নিরাপত্তা বলে ট্রেনে কিছুই নেই।”