ফাইল চিত্র।
টাকা না-থাকলে কোষাগারের অবস্থা নিয়ে হাহুতাশের মানে বোঝা যায়। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বৈষম্যের নালিশও যুক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু টাকা থাকা সত্ত্বেও কেন তা খরচ হয় না, কেন আঙুল তোলা হয় দিল্লির দিকে, সেটা এক বিষম ধাঁধা। জাতীয় আয়ুষ মিশনের টাকাকে ঘিরে এই ধন্দ ঘোরালো হয়েছে। রাজ্য উঠতে-বসতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ করে চলেছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে, বিশেষত আয়ুষ প্রকল্পে কেন্দ্রের দেওয়া টাকার একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকার খরচই করতে পারছে না, এমনকি সেই টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ হানছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তারা টাকা ফেরতের কথা মেনে নেওয়ায় ব্যাপারটা আর ঠিক অভিযোগের স্তরেও আটকে নেই। আয়ুষের টাকা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য লড়াই তুঙ্গে উঠেছে।
গত জুলাইয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জগদ্দলের বাসিন্দা, তরুণ আয়ুর্বেদ চিকিৎসক কেশবলাল প্রধানের তরফে তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনে এক আবেদনের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রক লিখিত ভাবে জানিয়েছিল, ২০১৪-২০ সাল পর্যন্ত ছয় অর্থবর্ষে আয়ুষে (হোমিয়োপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, যোগ, সিদ্ধা, ইউনানি চিকিৎসা এর অন্তর্গত) কেন্দ্রের দেওয়া ৯৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকার মধ্যে ৪৮ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা খরচই করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
কিছু দিন আগে সেই কেশববাবু আবার একটি আরটিআই আবেদন করেন। তার জবাবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ডেপুটি অ্যাডভাইজ়ার (আয়ুর্বেদ) সুরেশ কুমার জানান, ২০১৪-২০ পর্যন্ত খরচ করতে না-পারায় শেষ পর্যন্ত ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে আয়ুষের ন’কোটি টাকা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে পাকাপাকি ভাবে ফেরত দিতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতরকে।
অথচ অভিযোগ উঠছে, বিষয়টি এমন নয় যে, আয়ুষে পশ্চিমবঙ্গে করণীয় কিছু নেই। এখানে আয়ুষ গ্রামের সংখ্যা নগণ্য। কল্যাণীতে রাজ্যের একমাত্র সরকারি আয়ুর্বেদ ওষুধ তৈরির ফার্মাসি ধুঁকছে। প্রস্তাবিত ২০টি হেল্থ ওয়েলনেস সেন্টার তৈরির প্রক্রিয়া চলছে অত্যন্ত ঢিমেতালে। আলিপুরদুয়ার ও পূর্ব মেদিনীপুরে ইন্টিগ্রেটেড আয়ুষ হাসপাতাল তৈরি হয়েও চালু হয়নি। অনেক আয়ুষ ডিসপেন্সারি অকেজো। তবু ন’কোটি টাকা ফেরত গিয়েছে।
ওই ন’কোটি টাকা কেন্দ্রকে ফেরত দেওয়ার কথা স্বীকার করে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের হাতে কেন্দ্রের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ছিল। তার মধ্যে বেশ কিছুটা খরচ হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র আমাদের জানিয়েছিল, ওই টাকার ৭৫ শতাংশ খরচ না-হলে ওরা পরবর্তী পর্যায়ের টাকা দিতে পারবে না। তাই আমরা ন’কোটি ফেরত দিলাম। তাতে ওদের দেওয়া টাকার অনুপাতে আমাদের খরচের অনুপাত ৭৭ শতাংশে দাঁড়াল। তখন ওরা আরও ৫৬ কোটি টাকা আমাদের দিয়েছিল।’’
এখানেই শেষ নয়। কেন্দ্র গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজ্যসভায় জানিয়েছে, ২০১৮-২০২১ অর্থবর্ষ পর্যন্ত জাতীয় আয়ুষ মিশনে পশ্চিমবঙ্গকে মোট ৪৩ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে রাজ্য এখনও পর্যন্ত খরচ করেছে ২৩ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ হয়নি। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম বলেন, ‘‘টানা দু’বছর করোনার প্রকোপের জন্য আয়ুষের টাকা সে-ভাবে খরচ করা যায়নি।’’
গত সপ্তাহে রাজ্যসভায় কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তারা পশ্চিমবঙ্গকে দু’কোটি সাতচল্লিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। তার কোনও অংশই এখনও খরচ করতে পারেনি বাংলা।
স্বাস্থ্য অধিকর্তার বক্তব্য, মাঝখানে অনেকটা সময় যাবতীয় নজর ছিল করোনার উপরেই। তাই অন্য দিকে খুব একটা টাকা খরচ করা যায়নি। তা ছাড়া আয়ুষে সরকারি জায়গা থেকে ওষুধ ক্রয় নিয়ে মামলা চলছে। তাই টাকা থাকলেও ২০১৮ থেকে অনেক ওষুধ কেনা যাচ্ছে না। উপরন্তু করোনার জন্য আয়ুষের হেল্থ ওয়েলনেস
সেন্টার ও ইন্টিগ্রেটেড আয়ুষ হাসপাতাল চালু করার প্রক্রিয়া থমকে ছিল। সেই জন্যও টাকা খরচ করতে সমস্যা হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরের একটি অংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের একটা শক্তিশালী লবি আয়ুষ চিকিৎসা পরিষেবার উন্নয়নে বাধা তৈরি করছে। ওই ‘লবি’র অধিকাংশ চিকিৎসক শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে তাঁদের কথা সরকার ফেলতেও পারছে না। আবার কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আয়ুষ চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে বঙ্গের তৃণমূল ওই পদ্ধতিকে খানিকটা এড়িয়ে চলেছে বলে অভিযোগ।