এস জয়শঙ্কর। —ফাইল চিত্র।
আনুষ্ঠানিক বা ঘরোয়া কোনও পার্শ্ববৈঠক হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না। কিন্তু এস জয়শঙ্করের চব্বিশ ঘণ্টার ইসলামাবাদ সফরের পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে যৎসামান্য আশার আলো তৈরি হল কি না, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত বছর গোয়ায় এসসিওভুক্ত রাষ্ট্রগুলির বিদেশমন্ত্রীদের সম্মেলনে এসেছিলেন তৎকালীন পাক বিদেশমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো। কিন্তু বাক্যবাণে একে অপরকে বিদ্ধ করেছিলেন, তিক্ততা উঠেছিল চরমে। ন'বছর পর ভারতের কোনও বিদেশমন্ত্রীর ইসলামাবাদ সফর কিন্তু তুলনামূলক ভাবে কাটল অনেকটাই উষ্ণ আবহাওয়ায়। দু-দু'বার সৌজন্যমূলক কথা হল জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের মধ্যে। এসসিও বৈঠকের শেষে পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে মধ্যাহ্নভোজও সারলেন তাঁরা। ফেরার পথে নিজের সমাজমাধ্যমের হ্যান্ডলে পাকিস্তানের আতিথ্য, সৌজন্য ও উষ্ণতার প্রশংসাও করেছেন জয়শঙ্কর।
ঘটনা এটুকুই। কিন্তু কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের নিরিখে এই ঘটনারই সম্প্রসারিত ব্যঞ্জনা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রণকৌশলে। জয়শঙ্কর ফেরার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফ জানিয়েছেন, ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে শৈত্য রয়েছে, জয়শঙ্করের এই সফর তাতে ইতিবাচক বদল আনবে। নওয়াজ়ের বক্তব্য, জয়শঙ্করের সফরের পরে দু’দেশের অতীত সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে, যাতে শক্তিসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে যৌথ ভাবে মোকাবিলা করতে দু’দেশের সুবিধা হবে।
পাকিস্তানের বর্তমান শাসক জোটের প্রধান দল পিএমএলএন-এর প্রধান নওয়াজ়। তাই তাঁর বার্তায় গলে না গেলেও আপাতত তাকে উড়িয়ে না দিয়ে আতস কাচের নীচে রেখেছে সাউথ ব্লক। হিসাবে রাখা হচ্ছে যে, প্রবল অভ্যন্তরীণ তোলপাড়ের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। সে দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেকটাই রুগ্ন। চলছে বিচ্ছিন্নতাবাদ, হিংসা, অস্থিরতা, মন্দা, সেনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ। শাহবাজ়ের সরকার এবং পাক সেনা আতান্তরে পড়ে বিদেশনীতির সংস্কারের কথা (বিশেষ করে ভারত-নীতি) ভাবছে বলেই অনুমান করা হচ্ছে।
শুধু জয়শঙ্কর পোস্ট করেছেন বলে নয়, এই সফরে যে আতিথ্য এবং উষ্ণতার প্রদর্শন পাকিস্তানের তরফে করা হয়েছে, তা খেয়াল রাখছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারাও। বিলাওয়াল ভুট্টোর আচরণ ও ভাষ্যের থেকে তা অনেকটাই পৃথক। তবে অবশ্যই বিষয়টি অবিমিশ্র নয়। সেপ্টেম্বরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে শাহবাজ়ের বক্তৃতা ছিল ভারত-বিরোধী বয়ানে ভরপুর। অর্থাৎ বহির্বিশ্বের সামনে কাশ্মীর নিয়ে অনমনীয় মনোভাব আর ঘরোয়া চাপের মুখে নয়াদিল্লির সঙ্গে অন্তত কাজ চালানো বাণিজ্যের বন্দোবস্ত করা— এই ভারসাম্যেও চলতে পারে ইসলামাবাদের ভবিষ্যৎ নীতি। কূটনৈতিক মহলের খবর, পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরেরও এই পন্থায় সায় রয়েছে।
আপাতত বিশেষজ্ঞরা তিনটি কারণ দেখছেন ভারত সম্পর্কে পাকিস্তানের এই কৌশলগত পুনর্বিবেচনার। প্রথম কারণটি তাদের অর্থনৈতিক কোণঠাসা পরিস্থিতি। দ্বিতীয়টি, শরিফ পরিবারের নিজস্ব বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতি। নওয়াজের অভিভাবকত্বে পাকিস্তানের বর্তমান সরকার প্রশাসনের ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সংযোগ বাড়ালে তা নিজের দেশকে অর্থনৈতিক কোমা থেকে বের করে আনবে — এই ভাষ্য ধীরে ধীরে তৈরি করার চেষ্টা করছেন শরিফ-ভাইয়েরা। তবে সেনার সমর্থন না পেলে এই ভাষ্য পাকাপাকি ভাবে দিনের আলো দেখবে না, এটাও ঠিক। তৃতীয়ত,
আন্তর্জাতিক ময়দানে ভারতের উত্থানের বয়ান। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার বিষয়টি ইসলামাবাদকে ভাবাচ্ছে।
কূটনৈতিক শিবিরের মতে, পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের নীতি বরবারই প্রভাবিত হয়েছে তিন প্রকারের মতবাদে। সেগুলি যথাক্রমে বাস্তবপন্থা, উদারপন্থা এবং সংরক্ষণপন্থা। আপাতত মোদী সরকার সতর্ক ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে চাইছে বলে খবর। আগামী দিনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব তথা আইএসআই আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে কোন পথে চলে, সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে। জয়শঙ্করের কথায়, "আমরা পাকিস্তানের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু'রকম পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ার জন্যই
প্রস্তুত আছি।’’