প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ছবি পিটিআই।
এ কি বিশুদ্ধ রবীন্দ্রভক্তি? না সঙ্কটে পড়ে রবীন্দ্র শরণ? এড়ানো যাচ্ছে না প্রশ্নটা। রবিবাসরীয় সকালটায় মোদীর মুখে রবীন্দ্রনাম তবু বিশিষ্টজনের বিস্তর চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে।
এ যাত্রা, ‘মন কি বাত’-এ দেশের খেলনা শিল্পের সম্ভাবনা বা শিশুদের উপযুক্ত খেলনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রবীন্দ্র বিশারদদের মতে, উদ্ধৃতিটি দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান বইয়ের ‘চ্যাপ্টার ১০’ থেকে গৃহীত। । সে-বছর ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’ নামে প্রকাশিত বইটির পঞ্চম অধ্যায়ের এ বার শরণ নিয়েছেন মোদী। বলেছেন, ‘‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বলতেন, উত্তম খেলনা অসম্পূর্ণ হয়। শিশুরা খেলার মধ্যে দিয়ে তা পূর্ণ করে। আদর্শ খেলনা শিশুর শিশুত্বকে বিকশিত করে, সৃষ্টিশীলতাকে মেলে ধরে।’’
রবীন্দ্র বক্তৃতায় রয়েছে, ‘‘শৈশবে সামান্যের সম্ভারে আমি খেলনা গড়ে, কল্পনার জোরে নানা খেলা খেলতুম। শৈশবের সেই স্বর্গরাজ্যে বড়দের বাণিজ্যিক জগৎ দখল নিল। আমার এক খেলার সঙ্গী বিলিতি দোকানের দামি খেলনা পেয়ে তা আমাদের সবার কাছ থেকে আগলে রাখল।...খেলনার বিত্তে শিশুর খেলার আনন্দ, সৃষ্টিশীল মন গেল হারিয়ে।’’ এই অংশটির নির্যাস উল্লেখ করে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে উপযুক্ত খেলনার গুরুত্ব নিয়েও মোদী সরব হয়েছেন।
এর আগে বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্র তিরোধান দিবসেও মোদী কেন্দ্রের নতুন শিক্ষানীতি রবীন্দ্র ভাবাশ্রিত বলেই দাবি করেন। শিশুদের খেলনা ও শিক্ষানীতিতে শিশুদের জন্য খেলনার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মোদীর রবীন্দ্র উদ্ধৃতিতে আপত্তির কিছু দেখছেন না শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডসের উদ্যোগে তৈরি রবীন্দ্রনাথের বৈদ্যুতিন রচনা সম্ভার (বিচিত্রা) তৈরির অন্যতম প্রধান রূপকার সুকান্তবাবু বলছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো বেশ! নতুন শিক্ষানীতিতে ছোটদের শিক্ষার দিকটাও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাতে অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থাকেই শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকলে তা ভাল কথা।’’ তবে তাঁর সংশয়, ‘‘সার্বিক শিক্ষানীতিটি যে ভাবে শিক্ষাব্যবস্থার উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়, তাতে রবীন্দ্র ভাবনার স্বাধীন মনন, সৃষ্টিশীলতা, কল্পনার প্রতি কতটা সুবিচার করা যাবে কে জানে!’’
আরও পড়ুন: লক্ষ্য বাংলার ভোট? মোদী-মুখে রবির শরণ
ইতিহাসবিদ সুগত বসু আবার এই রবীন্দ্র-উদ্ধৃতির মধ্যে এক ধরনের ‘সুবিধাবাদ’ দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এত ঘন ঘন রবীন্দ্র উদ্ধৃতি স্পষ্টতই ২০২১-এ বাংলায় ভোটের দিকে তাকিয়ে।’’ এর আগে আত্মনির্ভরতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্র পংক্তি উচ্চারণের চেষ্টা (চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী) করেন মোদী। দু’বছর আগে ‘মন কি বাত’- এ মোদীর রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার দাবি নিয়েও নেটরাজ্যে হাসাহাসি হয়।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বা সুগতবাবুরা বলছেন, ‘‘মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে বৈষম্যমূলক আইনের প্রণেতা মোদীর সঙ্কীর্ণ আদর্শ রবীন্দ্রনাথের দেশ-ভাবনার সঙ্গে খাপ খায় না। মোদীর মুখে রবীন্দ্র-বাণী না শুনে তরুণদের নিজে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে বোঝা উচিত।’’
রজতবাবু আবার মোদীর রবীন্দ্রভজনায় অন্য একটি দিকও দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনৈতিক মতলব ছাড়াও ভারতের ইতিহাসে নিজেকে মহান পুরুষ বলে মেলে ধরতেও মোদী রবীন্দ্রনাথ বা গাঁধীকে আঁকড়ে ধরছেন। নিজেকে তাঁদের আদর্শের ধারক-বাহক প্রতিপন্ন করতে চান। মানুষকে ভুল বোঝানোর এই চেষ্টা আরও বিপজ্জনক।’’