দলিলের জবাবে পাল্টা দলিল! তত্ত্বের জবাবে পাল্টা তত্ত্ব! বিপর্যয়ের জেরে দলের লাইন পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রবল বিতর্ক সিপিএমে। এবং বিদ্রোহও!
নতুন রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইন ঠিক করতে গিয়ে ৩৬ বছর আগের জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চেয়েছেন প্রকাশ কারাট। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের যুক্তি মেনেই নতুন লাইন নির্ধারণের জন্য খসড়া দলিল তৈরি করেছে দলের পলিটব্যুরো। কিন্তু এ বার কারাটের ওই লাইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে পাল্টা দলিল পেশ করেছেন পলিটব্যুরোর আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি! দিল্লিতে রবিবার থেকে শুরু হওয়া সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ইয়েচুরির বিকল্প দলিল বিলি করা হয়েছে মতামত দেওয়ার জন্য। কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে দলের আনুষ্ঠানিক দলিলের জবাবি দলিল পেশকে কেতাবি কায়দায় বিদ্রোহের তুঙ্গ রূপ হিসাবেই ধরা হয়। সেই দিক থেকে বিশাখাপত্তনমে দলের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের আগে ইয়েচুরির পদক্ষেপ তোলপাড় ফেলে দিয়েছে সিপিএমে!
নাটকের শেষ অবশ্য এখানেই নয়! কারাট-শিবিরের মত মেনে ‘অফিসিয়াল’ দলিলের সঙ্গে তিনি যে একমত হতে পারছেন না এবং দলে এই নিয়ে প্রভূত বিতর্ক প্রয়োজন, পলিটব্যুরোয় সেই কথা আগেই জানিয়েছিলেন ইয়েচুরি। নিজের ভিন্ন মত নথিভুক্ত করাতে ওই দলিলের বিপক্ষে ভোটও দিয়েছিলেন রাজ্যসভায় সিপিএমের দলনেতা। তখনই বিকল্প দলিল তৈরির কথাও জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এর পরে চার দিনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরুর আগে এ দিন পলিটব্যুরোর বৈঠকে নতুন কৌশল নেয় কারাট-শিবির! ইয়েচুরির বিকল্প মতের মোকাবিলা করতে আরও একটি পৃথক দলিল তৈরি করে ফেলেন অন্ধ্রপ্রদেশের নেতা, পলিটব্যুরোর সদস্য বি ভি রাঘবুলু! দলীয় সূত্রের খবর, যে দলিল আসলে কারাটদের ‘অফিসিয়াল’ দলিলেরই সংযোজিকা মাত্র। রাঘবুলুর ওই দলিলও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিলি করতে দেওয়া হয়েছে।
দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “অফিসিয়াল দলিল একটাই। বাকি যা আছে, সবই ব্যক্তিগত নথি হিসাবে ধরা হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি সংশ্লিষ্ট সদস্যদের দেওয়া হয়েছে।” পরিস্থিতি ঘোরালো দেখেই আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরো। সচরাচর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পলিটব্যুরোর সদস্যদের বলার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এ বার পরিস্থিতির প্রয়োজনে পলিটব্যুরো সদস্যদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মুখ খোলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কারাটের যুক্তি শুনে নিজের বিকল্প দলিলের পক্ষে পাল্টা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন ইয়েচুরি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন তীব্র বিতর্ক কেন? লোকসভা ভোটে এ বার দেশ জুড়ে বেনজির বিপর্যয়ের জেরে দলের মধ্যে দাবি মেনেই রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাইন পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারাট। বাংলার সিপিএম নেতৃত্ব-সহ দলের একাংশের মত, ইউপিএ-১ জমানায় পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে মনমোহন সিংহের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে বিপর্যয়ের পথ প্রশস্ত করেছিলেন কারাটই। অশক্ত শরীরে জ্যোতি বসুও যে কারণে হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারাট বুঝেছেন, লাইন পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে তাঁকেই কাঠগড়ায় উঠতে হবে। বিপাকে পড়ে কারাট-শিবির তাদের খসড়া দলিলে বলেছে, ১৯৭৮ সালে জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তারই পরিণতিতে ধীরে ধীরে গোটা দেশে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সিপিএম। আর এখানেই পাল্টা দলিল পেশ করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন ইয়েচুরি!
ইয়েচুরির দলিলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে: ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ-হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ-জ্যোতিবাবুদের লাইন যদি ভুলই হয়ে থাকে, তা হলে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকার হয়েছিল কী ভাবে? জ্যোতিবাবুর জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব এসেছিল কী ভাবে? সংযুক্ত মোর্চার সরকার গঠিত হয়েছিল কী ভাবে? ইউপিএ-১ সরকার তৈরিতে ৬১ জন বাম সাংসদের সমর্থনই বা লেগেছিল কী ভাবে? এ সবের মানে অন্তত ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে সিপিএমের গুরুত্ব ছিল। পতন হয়েছে তার পরের ১০ বছরে! যে সময়ে দলের কর্ণধার রয়েছেন কারাট এবং সিপিএমের লোকসভার সাংসদ-সংখ্যা ৪১ থেকে ৯-এ নেমেছে! দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “ইয়েচুরির দলিলে বলা হয়েছে, ভুল হয়ে থাকলে ইএমএস-সুরজিৎদের লাইন প্রয়োগ করতে গিয়ে হয়েছে। সেই ভুল নিয়ে বিতর্ক দরকার। আগেকার লাইনটাই ভুল ছিল, এ কথা বলা মানে ইতিহাস এবং যুক্তিকে অস্বীকার করা।”
অতীতের বিশ্লেষণ নিয়ে এই প্রবল দ্বন্দ্বের ছায়া এসে পড়ছে দলের ভবিষ্যৎ লাইন নির্ধারণের প্রশ্নেও। আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে আঁতাঁতের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুধুই বৃহত্তর বাম ঐক্য? নাকি সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র মোকাবিলায় ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিতে একজোট করার চেষ্টা? দ্বন্দ্ব মূলত এই প্রশ্নেই।
কারাটের নেতৃত্বে পলিটব্যুরোর দলিল দলের নিজস্ব শক্তি বাড়ানো, সংগঠনকে ঢেলে সাজানো ও বৃহত্তর বাম ঐক্যের উপরে জোর দিয়েছে। সে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা ও উদার আর্থিক নীতির বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইয়েচুরির মত, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধিতাই এখন প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই তাঁর খসড়া দলিলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকাতে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গেও হাত মেলানোর কথা বলা হয়েছে। পলিটব্যুরোর একটি সূত্রের বক্তব্য, বিজেপি-কে ঠেকাতে প্রয়োজনে কংগ্রেসের সঙ্গেও সমঝোতার কথাও বলছেন ইয়েচুরি। আবার রাঘবুলুর (যিনি কারাটের পরে সাধারণ সম্পাদক পদের অন্যতম দাবিদার) মত কারাটদের মতোই। তাঁর যুক্তি, স্বল্পমেয়াদি নির্বাচনী ফায়দার কথা ভুলে দলের শক্তি বাড়ানো ও বাম ঐক্য মজবুত করাতেই জোর দেওয়া হোক। কংগ্রেস বা অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা একেবারেই ছেড়ে দেওয়া হোক।
পরিস্থিতি যা, দলিল এবং পাল্টা দলিল নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ভোটাভুটির দিকেও যেতে পারে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও কারাট-পন্থীরা সংখ্যায় ভারী। এবং সে কারণেই বিক্ষুব্ধেরা সচরাচর বৈঠকে মুখ খোলেন না। সেই ভয় জয় করতে ইয়েচুরিদের এগিয়ে আসাই এ বার তাৎপর্যপূর্ণ। এখন দেখার, বঙ্গ ব্রিগেডের ভূমিকা কী হয়!