Maharashtra

অজিতের পিছলে যাওয়ার নেপথ্যে কি শরদেরই নকশা? সন্দেহ কাটছে না কংগ্রেসের

শিবসেনা কিন্তু শরদ পওয়ারকে অবিশ্বাস করছে না। শনিবার সকালে কংগ্রেস নেতারা শরদকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শিবসেনা সে পথে হাঁটেনি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৯:১৯
Share:

গ্রাফিক— তিয়াসা দাস।

যা ঘটে গিয়েছে শনিবার ভোররাতে, গত ৭২ বছরে সে রকম রাজনৈতিক নাটক ভারত দেখেনি। কিন্তু যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, সেটাই মূল নাটক, নাকি আসল চিত্রনাট্য রয়ে গিয়েছে পর্দার আড়ালে, প্রশ্ন তা নিয়েও। বিজেপি সরকার গড়ে ফেলেছে মহারাষ্ট্রে, দেবেন্দ্র ফডণবীস ফের মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথ নিয়ে ফেলেছেন। আর শরদ-উদ্ধব দাবি করেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবেন না ফডণবীস। কিন্তু কোনও দাবি সম্পর্কেই নিশ্চিত হতে পারছে না রাজনৈতিক শিবির। বিজেপির ‘গেমপ্ল্যান’, অজিত পওয়ারের শক্তি, শরদ পওয়ারের ভূমিকা— সংশয় অনেক কিছু নিয়েই। অতএব মহারাষ্ট্র আপাতত জল্পনার স্বর্গরাজ্য।

Advertisement

দেবেন্দ্র ফডণবীসকে মুখ্যমন্ত্রী এবং অজিত পওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে বিজেপি সরকার গড়েছে— এ খবর সামনে আসার পরে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি দিল্লিতে বসে থাকা কংগ্রেস নেতারা। দলের অন্যতম মুখপাত্র তথা সাংসদ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি টুইটারে লিখেওছেন যে, প্রথমে তাঁর মনে হয়েছিল ভুয়ো খবর পেয়েছেন। কিন্তু খবরটা যে ভুয়ো নয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই কংগ্রেস নিশানা করা শুরু করেছিল এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারকে। কারণ কংগ্রেস ধরেই নিয়েছিল যে, শুক্রবার মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পরে বিজেপির সঙ্গে গোপনে আঁতাত সেরে নিয়েছেন শরদ। ভাইপোকে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে বিজেপি-কে সমর্থন দিয়ে দিয়েছেন। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি টুইটারে লেখেন, ‘‘পওয়ারজি তুস্‌সি গ্রেট হো!’’

কংগ্রেসের সন্দেহের নিশানায় শরদ পওয়ার একেবারেই অকারণে এসে পড়েছিলেন, এমন কিন্তু নয়। এর আগেও কিন্তু অজিত পওয়ার ঠিক এ ভাবে কাকা শরদের ‘অবাধ্য’ হয়েছিলেন। উপমুখ্যমন্ত্রী পদও আদায় করেছিলেন। বার বার অজিতের এই ‘অবাধ্যতা’ কি সত্যিই অবাধ্যতা? নাকি নেপথ্যে ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ নিজেই? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠে গিয়েছে মহারাষ্ট্রে।

Advertisement

আরও পড়ুন: পাশ করো আগে, তার পর মডেলিং, বাবা-মার শাসনে আত্মঘাতী কলকাতার নামী স্কুলের ছাত্রী!

আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি-সহ নানা অভিযোগে নাম জড়ানোয় কংগ্রেস-এনসিপি জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল কংগ্রেসের অশোক চহ্বাণকে। সেটা ২০১০ সাল। কংগ্রেসের পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু সেই মন্ত্রিসভায় অজিত পওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করতে হয়েছিল। উপমুখ্যমন্ত্রী পদ না পেলে অজিত দল ভাঙতে পারেন এবং বিজেপি-শিবসেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়তে পারেন— এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সে বার। ভাইপোর সেই দাবিকে তিনি সমর্থন করছেন না— এমন ভঙ্গি করেছিলেন শদ। কিন্তু তিনি অসহায়, তাঁর কিছু করার নেই— এমনও কংগ্রেসকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

এ বারও সেই পথেই এগোল নাটক। ২০১০ সালে কংগ্রেসকে যে রকম ‘ব্ল্যাকমেলিং’-এর সম্মুখীন হতে হয়েছিল, এ বার শিবসেনাকে তার মুখে পড়তে হল না। এ বার আসলে সে সুযোগই দিলেন না অজিত। গোপনে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ হল তাঁর। বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ হল অজিতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আর এক বিধায়ক ধনঞ্জয় মুন্ডেরও, যিনি প্রয়াত বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুন্ডের ভাইপো এবং এ বারের ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভোটে লড়ে গোপীনাথের মেয়ে পঙ্কজাকে হারিয়ে দিয়েছেন। নিঃশব্দে বিজেপির সঙ্গে কথা সেরে ফেললেন অজিত-ধনঞ্জয়। ভোরবেলা এনসিপি বিধায়কদেরকে অজিত ডেকে পাঠালেন রাজভবনে। তার পরে সেখানে পৌঁছলেন দেবেন্দ্র ফডণবীস, চন্দ্রকান্ত পাতিলরাও। দেবেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, অজিত উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।

শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের সরকার গড়ার প্রক্রিয়ায় কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শামিল ছিলেন অজিত। শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্তও তাঁকে জোট শিবিরে দেখা গিয়েছিল। তার পর ‘গায়েব’ হয়ে যান বলে শিবসেনার দাবি। রাতে তাঁর সঙ্গে আর ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না বলে শনিবার সকালে শিবসেনার অন্যতম শীর্ষনেতা সঞ্জয় রাউত জানিয়েছেন। তত ক্ষণে কিন্তু খেলা হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন: সন্ধ্যায় অজিতকে এনসিপি থেকে বহিষ্কার? এত বড় প্রতারণার শিকার হইনি, বার্তা সুপ্রিয়া সুলের

অজিত কি সত্যিই শরদের অবাধ্য হলেন? সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজেপির হাত ধরলেন? নাকি মরাঠা স্ট্রংম্যানের তৈরি করা নেপথ্য নকশা অনুযায়ীই সব ঘটে গেল? এ প্রশ্ন মহারাষ্ট্রে থাকছেই? বস্তুত এ প্রশ্নের উত্তর গোটা দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাই খুঁজছেন। কারণ, সুচতুর রাজনীতিক হিসেবে শরদের পরিচিতি রয়েছে গোটা দেশেই।

শিবসেনা কিন্তু শরদ পওয়ারকে অবিশ্বাস করছে না। শনিবার সকালে কংগ্রেস নেতারা শরদকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শিবসেনা সে পথে হাঁটেনি। শিবসেনা সূত্রে প্রথমে জানানো হয় যে, শরদ পওয়ারের সঙ্গে সকালেই উদ্ধব ঠাকরের কথা হয়েছে। পরে শরদ নিজে টুইট করেন এবং জানান, অজিতের সিদ্ধান্ত তাঁর ব্যক্তিগত, দল এই সিদ্ধান্তের শরিক নয়। তার পরে কংগ্রেসের আক্রমণ থেমেছে ঠিকই, কিন্তু শরদকে আক্রমণ করে যে সব টুইট কংগ্রেস নেতারা করেছিলেন, সে সব তাঁরা ডিলিট করেননি। ওয়াই বি চহ্বাণ সেন্টারে উদ্ধবকে সঙ্গে নিয়ে শরদ যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, কংগ্রেস তাতেও যোগ দেয়নি।

শুধু শরদ পওয়ার নন, তাঁর মেয়ে সুপ্রিয়া সুলেও কিন্তু এ দিন অজিত পওয়ারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এত বড় প্রতারণার মুখে কখনও পড়েননি— টুইটারে লিখেছেন সুপ্রিয়া। হোয়াটসঅ্যাপে নিজের স্টেটাস বদলে দিয়েছেন তিনি। নতুন স্টেটাসে লিখেছেন— দল এবং পরিবার ভেঙে গেল। এর পরেও কি প্রশ্ন তোলার বা শরদের ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ থাকে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত, প্রশ্ন তোলার অবকাশ এর পরেও থাকে। শরদের হাত ধরেই উত্থান অজিত পওয়ারের, শরদের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেলে অজিত আদৌ কিছু করে উঠতে পারবেন কি না, সংশয় তা নিয়ে যথেষ্টই। সেই অজিত বার বার বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, সেই অজিত বার বার উপমুখ্যমন্ত্রী পদ আদায়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। অথচ শরদ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেন না, কেন? প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েই।

২০১০ সালে যখন ‘ব্ল্যাকমেলিং’ করেছিলেন অজিত, তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর ডানা ছাঁটতে শরদ উদ্যোগী হননি কেন? প্রশ্ন রাজনৈতিক শিবিরের। এ বার ‘দলের লাইনের বিপরীতে গিয়ে’ অজিত বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালেন, ফডণবীস সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। তার পরেও অজিত পওয়ারকে কেন বহিষ্কার করা হল না? প্রশ্ন অনেকেরই।

এনসিপি বলছে, অজিত পওয়ার এবং তাঁর অনুগামীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এখনই ছাড়তে চাইছেন না শরদ পওয়ার। তাই বহিষ্কারের পথ নেননি। উপমুখ্যমন্ত্রী পদে অজিত শপথ নেওয়ার পরেও যে এনসিপি নেতৃত্ব তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সে কথা মিথ্যা নয়। অজিতের ঘনিষ্ঠ ধনঞ্জয় মুন্ডে শনিবার সন্ধ্যায় এনসিপি নেতৃত্বের সঙ্গে দেখাও করেছেন জল্পনার নতুন পর্ব উস্কে দিয়ে। কিন্তু গত বুধবার যে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শরদ পওয়ারের বৈঠক হয়েছিল, সে কথাটাও ভুলতে বারণ করছেন কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ। বিজেপি-কে বাদ রেখে জোট সরকার গড়ার বিষয়ে শিবসেনা এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যখন তাঁর দফায় দফায় বৈঠক চলছে, তখনই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কেন বৈঠকে বসতে হল শরদ পওয়ারকে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক। পওয়ার বলেছিলেন, মহারাষ্ট্রের কৃষকদের সমস্যা নিয়ে তিনি মোদীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের রাজনীতি যখন টালমাটাল, তখন মোদী এবং পওয়ার মুখোমুখি হলেন, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা হল না, এই তত্ত্ব অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement