প্রথম জীবনে শিল্পী। তারপর অটোচালক। সেখান থেকে পরিণত হয়েছিল নৃশংস খুনিতে। দেশের অপরাধ ইতিহাসে অন্যতম সিরিয়াল কিলার অটো শঙ্করের নামে এক সময় ত্রস্ত ছিল আজকের চেন্নাই।
১৯৫৪ সালের ২১ জানুয়ারি তার জন্ম চেন্নাইয়ের ভেলোর জেলার কাঙ্গেইয়ানাল্লুর গ্রামে। জন্মগত নাম ছিল গৌরীশঙ্কর। পরে সে পেরিয়ারে গিয়ে থাকতে শুরু করে। সেখানেই অটোচালকের পেশায় পা রাখা।
কিন্তু সাধারণ যাত্রিবাহী অটো নয়। তার অটো ব্যবহৃত হত মূলত চোরাই মদ পাচারের কাজে। তিরুভন্মিয়ুর এবং মমল্লপুরমের এলাকায় উপকূলীয় গ্রাম থেকে সে শহরে পৌঁছে মদের বোতল ভর্তি চোরাই বাক্স। এমনকি, কাজে লাগাত নারীপাচারের চক্রেও।
ক্রমে অপরাধ জগতে আরও মজবুত হতে লাগল তার জায়গা। ততদিনে নামের আগে যোগ হয়েছে ‘অটো’। বিদায় নিয়েছে ‘শঙ্কর’। দেহব্যবসা চক্রেও কুখ্যাত হয়ে ওঠে তার নাম। পেরিয়ার ছিল তার ঘাঁটি।
দুষ্কর্মে অটো শঙ্করের মূল চক্রী ছিল তার ভাই অটো মোহন। এছাড়া তাদের দলের বাকি সক্রিয় সদস্য ছিল এলডিন, শিবাজি, জয়াভেলু, রাজারমন, রবি, পালানি এবং পরমশিবম। আশির দশকের শেষে এই চক্রের বিরুদ্ধে অন্তত ছ’টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের দাবি, আরও অনেক ঘটনায় রক্তাক্ত হয়েছে তাদের হাত। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পুলিশের কাছে নথিভুক্ত শঙ্করের প্রথম অপরাধ ছিল ললিতা নামে এক তরুণীকে খুন । ললিতা ছিল অটোশঙ্করের চক্রের সদস্য। কিন্তু সে অন্ধকার দুনিয়া থেকে বাইরে বেরিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। পালিয়েছিল দলেরই আর এক সদস্য সুদালাইমুথুর সঙ্গে।
কিন্তু তারা পালিয়ে বেশিদিন বাঁচতে পারেনি। ধরা পড়ে গিয়েছিল দলের হাতে। তদন্তে জানা যায়, খুনের পরে ললিতার দেব পুঁতে ফেলা হয়েছিল পেরিয়ার নগরের পরিত্যক্ত জমিতে। তার সঙ্গীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর দেহাংশ কম্বলে জড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। এক বছরেরও বেশি সময় পরে উদ্ধার হয়েছিল ললিতার দেহাবশেষ।
অপরাধ জগতে নিজের জায়গা পোক্ত করতে গিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল শঙ্কর। তার বিরোধী গোষ্ঠীর তিন দুষ্কৃতীকে খুন করে পেরিয়ারে পুঁতে ফেলেছিল শঙ্কর ও তার চক্রীরা। এছাড়াও জনৈক রবি নামে এক যুবকের খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয় শঙ্কর ও তার সঙ্গীরা।
বেশ কয়েক বছর ধরে শঙ্কর পর পর অপরাধ চালিয়ে গেলেও পুলিশ তার নাগাল পায়নি। শেষে ১৯৮৮ সালে পেরিয়ারে ললিতা ও আরও তিন নিহতের দেহাবশেষ উদ্ধার হওয়ায় তামিলনাড়ু জুড়ে চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
এরপর আর পুলিশের ফাঁদ এড়িয়ে থাকতে পারেনি অটো শঙ্কর। গ্রেফতার করার পরে অটো শঙ্করকে জেরা করে জানা যায়, পুলিশের বিভিন্ন আধিকারিকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়রিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার ছবি। এর জেরে সাসপেন্ড করা হয় দুই পুলিশকর্মীকে। দীর্ঘ ছুটিতে পাঠানো হয় এক ডেপুটি সুপারকে।
চেন্নাই কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে রাখা হয়েছিল বন্দি অটো শঙ্করকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে সেখান থেকে দুঃসাহসিক উপায়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে। তাকে পালাতে সাহায্য করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় জেলের ওয়ার্ডেন।
দু বছর পরে ফের অটো শঙ্কর ধরা পড়ে পুলিশের জালে। বিচারে তার প্রাণদণ্ড হয়। তার পাঁচ সঙ্গীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পাশাপাশি শঙ্করকে জেল থেকে পালাতে সাহায্য করার দায়ে কারাবাসের শাস্তি হয় তিনজন ওয়ার্ডেনের।
১৯৯৫-এর ২৭ এপ্রিল সালেমের সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি হয় অটো শঙ্করের।
অটো শঙ্করের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা এবং সিরিয়াল। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল ছবি ‘পুলান ভিসিরানাই’-এর বিষয় ছিল এই সিরিয়াল কিলারের জীবন। পরবর্তী কালে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে টেলিভিশন সিরিয়াল ও ওয়েবসিরিজ-ও। (ছবি: আর্কাইভ, ফেসবুক এবং শাটারসস্টক)