ফাইল চিত্র।
কর্মজীবনে নিরপেক্ষ এবং দুঁদে আমলা হিসেবে পরিচিত থাকলেও রাজধানীর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দু’বছরে গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে এতটাই রং মিলিয়ে নিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যে, তাঁর সেই ‘নিরপেক্ষ’ অতীত এখন ধূসর! চলতি আমেরিকা সফরে তিনি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কড়া সমালোচনার মুখে দেশের বর্তমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত সংজ্ঞা’ দিয়েছেন। জানিয়েছেন, ‘ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্য’ তুলে ধরে তাকে পৃথক ভাবে দেখানো হচ্ছে। জয়শঙ্করের বক্তব্য, ‘এখন ভারতবাসী তাঁর নিজ নিজ সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস (ধর্মীয়) নিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।’ বিদেশে বিজেপি তথা আরএসএস-এর আদর্শকে তুলে ধরতে তাঁকেই এখন শ্রেষ্ঠ দূত এবং প্রধানমন্ত্রীর ভরসার জায়গা হিসেবে দেখছে বিজেপি। তবে চলতি আমেরিকা সফরে জয়শঙ্করকে কাঠগড়ায় তুললেন আমেরিকার প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার। ভিডিয়ো মাধ্যমে একটি আলোচনাচক্রে তিনি ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীকে নিশানা করে জানান, অতিমারির এই প্রকোপের মধ্যেও ভারত সরকারে হিন্দুত্ববাদী নীতিতে পশ্চিম বিশ্ব উদ্বিগ। আশঙ্কা, ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে। আমেরিকায় ট্রাম্প জমানার এই কর্তার প্রশ্ন, এই নিয়ে কী বলবেন বিদেশমন্ত্রী? উত্তরে পোড় খাওয়া রাজনীতিকের ভঙ্গিতেই জয়শঙ্কর বলেছেন, “আমরা আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে পুরো মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী। সরকারের প্রকৃত প্রশাসনিক পরিসংখ্যান ও তথ্যের সঙ্গে বানানো রাজনৈতিক চিত্রণের পার্থক্য রয়েছে।”
মোদী সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতি নিয়ে যাবতীয় সমালোচনাকে ‘বানানো’ বলে বিদেশের মাটিতে দাবি করেছেন বিদেশমন্ত্রী। কিন্তু দেশের মাটিতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী নাম করেই আক্রমণ করেছেন জয়শঙ্করের নীতিকে। রাহুলের বক্তব্য, “ভারতকে যে ভাবে ‘সফট পাওয়ার’ হিসাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা হয়েছে, যে আত্মপ্রচার করা হচ্ছে, তা দেখে মনে হয়, বিদেশমন্ত্রীর ভাবনাচিন্তাতেই মৌলিক সমস্যা রয়েছে। দেশের সঙ্গে বিশ্বকেও সামালানোর যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট, মোদী সরকার একটা বুদবুদের মধ্যে বাস করছে।” তাঁর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীর সমস্যা হল, কেউ তাঁকে সত্যি কথাটা বলছে না।”
কংগ্রেসের অভিযোগ, এত দিন ধরে প্রতিষেধক কূটনীতির কথা বলে এখন বিদেশমন্ত্রীকেই হাত পাততে আমেরিকায় ছুটতে হয়েছে! দেশের প্রতিষেধকের ভাঁড়ারে টান। রাহুলের কথায়, দেশের ৩ শতাংশকে পুরো ডোজ দেওয়া হয়েছে, বাকিদের নয়। অথচ মোদী সরকার বাইরের দেশে প্রতিষেধক মৈত্রী করছিলেন! তিনি বলেন, “বিদেশমন্ত্রী বলে বেড়িয়েছেন, গোটা বিশ্বকে প্রতিষেধক জুগিয়ে ভারত সম্মান কুড়িয়েছে। আর এখন দেশের কি হাল! মাত্র তিন শতাংশ মানুষ প্রতিষেধক পেয়েছেন। তার মানে ৯৭ শতাংশের সম্ভাবনা রয়েছে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার।”
বিদেশের (আমেরিকা) মাঠে অবশ্য বুক চিতিয়েই ব্যাটিং করতে দেখা গিয়েছে বিদেশমন্ত্রীকে। তাঁর সরকার যে শুধু মাত্র হিন্দুত্ববাদের নীতি নিয়েই চলে না, সেই যুক্তি প্রতিষ্ঠায় আমেরিকার কর্তাকে তাঁর জবাব, “আমার মনে হয় আপনাদের প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করা উচিত, আসল রাজনৈতিক মঞ্চটা দেখা প্রয়োজন।” তাঁর কথায়, অতীতে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি হয়েছে ভারতে, জাতপাত বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাজনীতি হয়েছে। জয়শঙ্কর বলেছেন, “ঘটনা হল, আমরা তার থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। এখন অনেকটাই অন্য রকম ভারত। আমাদের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যাখ্যা করা হয় সমস্ত বিশ্বাসের প্রতি সমমর্যাদাকে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এই নয় যে তুমি নিজের বা অন্যের বিশ্বাসকে অমান্য করবে।”