প্রধানমন্ত্রীর মুখে মণিপুরি স্কার্ফ। —ফাইল চিত্র।
কোভিড-কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছেন, তখন তাঁর নাক-মুখ ঢাকা ছিল গলায় ঝোলানো মণিপুরী চাদরে। মণিপুরে হিংসা-সংঘর্ষের পরে দেড় মাস কেটে গেলেও সেই প্রধানমন্ত্রী মুখ বুজেই আছেন। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর রেডিয়ো-বার্তা ‘মন কি বাত’-এর আগে দাবি উঠেছিল, নরেন্দ্র মোদী সেখানে ‘মণিপুর কি বাত’ করুন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে হিংসা ঠেকাতে কেন্দ্র বা রাজ্যের বিজেপি সরকারের ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দেওয়া দূরে থাক, মণিপুরের মানুষের কাছে শান্তির আহ্বানও জানাননি।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে বিবৃতি জারি করে বলেছেন, গত ৪৫ দিন ধরে মণিপুরে লাগাতার হিংসা প্রবল উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, সেনা, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে অবিলম্বে হিংসা বন্ধ করার পদক্ষেপ করতে আর্জি জানিয়েছেন তিনি। প্রশ্ন উঠেছে, আরএসএস কি তবে ঘুরিয়ে মোদী সরকারের ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলছে? কংগ্রেসের অভিযোগ, আরএসএস আসলে দ্বিচারিতা করছে। আরএসএসের মেরুকরণ ও বিভাজনের মতাদর্শের জন্যই বৈচিত্র্যে ভরা উত্তর-পূর্ব বদলে যাচ্ছে। মণিপুর তার নিদারুণ নমুনা।
আজ ‘মন কি বাত’-এ বহু মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজের প্রশংসা করেন বলে মোদী জানিয়েছেন। জরুরি অবস্থা নিয়ে কংগ্রেসকে নিশানা করেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলা করার জন্য গুজরাতের কচ্ছের মানুষের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মণিপুর নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। মণিপুরের সড়কে দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ চলাকালীন মানুষ রেডিয়ো রাস্তায় আছড়ে ভেঙে ফেলছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে আজ অটলবিহারীয় বাজপেয়ীর সুরে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালন করতে বলেছেন। তাঁর অভিযোগ, মোদী মণিপুর নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি, নিজে কোনও বৈঠক করেননি, সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গেও দেখা করেননি।
বিরোধীদের অভিযোগ, যখনই তাঁর সরকার অস্বস্তিতে পড়ে, তখনই নরেন্দ্র মোদী মুখ বুজে থেকে দায় এড়িয়ে যেতে চান। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে অক্সিজেনের আকাল, লাদাখে চিনের ভারতীয় জমি দখল বা বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মহিলা কুস্তিগিরদের বিক্ষোভ— কোনও বিষয়েই মোদী মুখ খোলেন না। এত দিন তিনি উত্তর-পূর্বে তাঁর সরকারের সাফল্য নিয়ে ঢাক পিটিয়েছেন। কিন্তু মণিপুরে দেড় মাস ধরে অশান্তি চললেও প্রধানমন্ত্রী শান্তির আহ্বান জানাননি। মণিপুরে যাওয়া তো দূরের কথা।
কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশের প্রশ্ন, মোদীর আরও একটি ‘মন কি বাত’ হয়ে গেল। এখনও তিনি শান্তির আহ্বানটুকুও জানাতে পারলেন না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষমতার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন। মণিপুরে মানবিক বিপর্যয়ের কী হবে? আজ আরএসএস কিন্তু তার বিবৃতিতে শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। জয়রামের প্রশ্ন, “আরএসএসের বিখ্যাত প্রাক্তন প্রচারক (মোদী), যিনি কেন্দ্রের ও রাজ্যের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর কী হল? তিনি কি শান্তির আহ্বান জানানোর দায়িত্ব আরএসএসের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন? উনি কি প্রধানমন্ত্রী নন, শুধুই প্রচারমন্ত্রী?”
বিজেপিশাসিত মণিপুরে মে মাসের গোড়া থেকে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত চলছে। সরকারি হিসেবেই একশোর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরছাড়া। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে রাজ্যের মন্ত্রীদের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেও সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে পারেননি। মেইতেই রাজনীতিবিদরা চাইছেন, কুকি জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি প্রত্যাহার করে অভিযান শুরু হোক। বিজেপির সাত জন-সহ দশ জন কুকি জনজাতি বিধায়ক পৃথক প্রশাসন চাইছেন।
কংগ্রেসের প্রশ্ন, অমিত শাহ মণিপুর ঘুরে এসে বিজেপির হয়ে জনসংযোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি মণিপুর সামলানোর দায়িত্ব হিমন্তবিশ্ব শর্মার উপরে ছেড়ে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী তিন দিন পরে আমেরিকা সফরে চলে যাবেন। মণিপুরের কী হবে? রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহের প্রশ্ন, মণিপুর কি ভারতের বাইরে?