দিল্লিতে রোহিঙ্গা শিবিরে। ছবি: সোমা মুখোপাধ্যায়
এ যেন এক বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড ।
এই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের সম্পর্কে অধিকাংশ দিল্লিবাসীর মাথাব্যথা নেই। আর ওঁরাও চান না, বাইরের পৃথিবীর আলো ওঁদের মুখে খুব বেশি পড়ুক। ভয় পান, প্রচারে এলেই যদি মাথার ছাদটুকু চলে যায়? সভ্য সমাজের প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কী ভাবে দিন কাটছে দক্ষিণ দিল্লির রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের, তা না-দেখলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। এক দিকে, শাহিনবাগে যখন পায়ের তলার মাটি টলোমলো হওয়া মানুষেরা অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করছেন, তখন ওঁরাও লড়ে যাচ্ছেন নিজেদের মতো করে। ভিন্ দেশে কোনও মতে বেঁচে থাকার সুযোগটুকু পেতে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানেন, তাঁরা যেখানে থাকছেন তার অদূরেই রাতের পর রাত রাস্তায় কাটাচ্ছেন বহু মানুষ। আপনাদের কেউ কি গিয়েছিলেন সেখানে? প্রশ্নটা করতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ফতিমা। বলেন, ‘‘আমরা কেন যাব? ওঁরা আর আমরা তো এক নই। ওঁদের জন্য তো আপনারা ছুটে আসছেন, আমরা বেঁচে আছি কিনা সেই খবর কেউ রাখছে? বিরক্ত করবেন না, চলে যান এখান থেকে।’’
চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলেই নিজের কাজে মন দেন ফতিমা। কী সেই কাজ? বছর তিনেকের মেয়ের কপালের রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে এক দলা চুন লেপে দেওয়া। কী হয়েছে ওর? ফতিমা উত্তর দেন না। শিশুটি জানায়, ইঁদুরে কামড়ে দিয়েছে। আগেও নাকি তাকে তিন বার কামড়েছিল। আর তার ছ'মাস বয়সি ভাইকে এর মধ্যেই দু'বার!
চার পাশে আবর্জনার স্তূপ। শুয়োর চরে বেড়াচ্ছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়।
পর পর ঝুপড়ি। ভিতরে উঁকি মারলে আঁতকে উঠতে হয়। চার দিকে ভন ভন করছে মশা। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও ভুগছেন কেউ কেউ। চতুর্দিকে প্লাস্টিকের ছাউনি। ২০১৮-র এপ্রিলে বড় ধরনের আগুন লেগেছিল। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ আস্তানা। তার পরেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। না প্রশাসন, না বাসিন্দা, ভ্রুক্ষেপ নেই কারওই। পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই।
ঘরে ঘরে ডায়েরিয়া। পরিচ্ছন্নতার ছিটেফোঁটাও নেই। নেই শিক্ষার ব্যবস্থাও। শিশুর হাতে চিপসের প্যাকেট আছে। কিন্তু ওষুধ নেই। রোহিঙ্গা কিশোর গুনগুন করে হিট হিন্দি ছবির গান গায়। কিন্তু তার অক্ষর পরিচয়টুকু নেই।
বহু খোঁজ করার পরে দক্ষিণ দিল্লির মদনপুর খাদারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হদিস মিলেছিল। ২০১২ সাল থেকে ৫২টি রোহিঙ্গা পরিবারের বাস এখানে। শিশু, কিশোর-কিশোরীরা অনায়াসে হিন্দি বললেও বয়স্কদের মধ্যে ভাষা বোঝা ও বলার সমস্যা প্রবল। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই পরিবারগুলি চায়, এ দেশে তাদের আশ্রয় মিলুক। ডাঁই করা ময়লা বাছতে বাছতে এক প্রৌঢ় যেমন বললেন, ‘‘ওখানে ফিরলে বাঁচব না। এখানে শুধু থাকতে দিক। আর কোনও সুযোগসুবিধা চাই না।’’
কেউ ছোট চায়ের দোকান খুলেছেন। কেউ সেলাই করেন। কেউ নাম ভাঁড়িয়ে দিল্লির কোনও পরিবারে পরিচারিকার কাজ করেন।
এলাকার বয়স্কদের মধ্যে কথা বলার অনীহা প্রবল হলেও ছোটরা খুবই উৎসাহী। আব্দুর রহিম, কাশেমের মতো কিশোররা ঘিরে ধরে জানতে চায়, ‘‘বলুন না, আমাদের অবস্থাটা পাল্টাবে?’’
শৌচাগার নেই। খোলা জায়গাই ভরসা। খাস দিল্লিতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে মোদীর স্বচ্ছ ভারত। ২০ বছরের সোনি জানালেন, বাচ্চাটা ছোট, তাকে কোলে নিয়েই যেতে হয়। দিন কয়েক আগে কোনও একটা বিষাক্ত পোকা শিশুটিকে কামড়েছে।
রাতে শাহিনবাগে বসে কথা হচ্ছিল সুহানি আর তার স্বামী আরমানের সঙ্গে। রোহিঙ্গা শিবিরের প্রসঙ্গ তুলতেই আরমান বলেন, ‘‘যে-কোনও মুহূর্তে মাথার ছাদটা চলে যেতে পারে, এই অনুভূতিটা কখনও টের পাইনি। তাই ঘরের পাশে বছরের পর বছর ধরে ওঁরা থাকলেও আলাদা করে কিছু ভাবিনি ওঁদের নিয়ে। বরং এত অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকেন, সেটা দেখে বিরক্তই হয়েছি বেশিরভাগ সময়। ওঁদের কষ্টটা এখন বুঝছি।’’
এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন সুহানি। এ বার স্বামীর দিকে তাকিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী তরুণীটি বলেন, ‘‘আমরা তো ওখানে হেলথ ক্যাম্প করতে পারি। সপ্তাহে এক দিন ক্লাসও তো নেওয়া যায়, তাই না?’’
শাহিনবাগ ওঁদের ভাবতে শিখিয়েছে, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে বড় কর্তব্য আর কিছু হয় না।