বন্দুকের নলেই? ‘বিচারের’ আড়ালে ব্যর্থতা

সর্বভারতীয় প্রগতিশীল মহিলা সংগঠনের নেত্রী কবিতা সাত বছর আগে দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণের প্রতিবাদে রাজপথের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:০৪
Share:

হায়দরাবাদ ধর্ষণে এক অভিযুক্তের দেহ ঘিরে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ এবং পুলিশ। শুক্রবার শাদনগরে। ছবি: এএফপি

পুলিশের ‘এনকাউন্টারে’ ধর্ষণে অভিযুক্তদের গুলি করে দেওয়াটাই ঠিক বিচার— বিভিন্ন মাধ্যমে গণউল্লাসের এই ছবিটাই যখন প্রধান হয়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়ল একটি বিবৃতি। একটি মহিলা সংগঠনের তরফে তাতে লেখা রয়েছে, ‘না, আমাদের নাম করে হত্যা নয়। মহিলাদের নিরাপত্তার নামে, পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায়, বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটানোর চেষ্টায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করা হবে না।’ সাধারণ নাগরিক, বিশিষ্ট জন এমনকি সাংসদদের একাংশ যখন হায়দরাবাদের ঘটনাকে ন্যায় বিচার বলে সমর্থন করেছেন, মিষ্টি খাইয়েছেন, বাজি পুড়িয়েছেন, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী বা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা সাফ বলেছেন, ‘এনকাউন্টার’ ন্যায় বিচার হতে পারে না।

Advertisement

সর্বভারতীয় প্রগতিশীল মহিলা সংগঠনের নেত্রী কবিতা সাত বছর আগে দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণের প্রতিবাদে রাজপথের আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘যদি আজ পুলিশবাহিনী হত্যা করে রেহাই পেয়ে যায়, তা হলে আগামিকাল সেই পুলিশবাহিনী কোনও মহিলাকে ধর্ষণ এবং খুন করেও রেহাই পেয়ে যাবে। পুলিশবাহিনী বিশ্বাস করবে, তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না।’’

তা হলে কেন মানুষ পুলিশের এনকাউন্টারকেই সুবিচার বলে মনে করছেন? সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা নন্দীর মতে, ‘‘আইনি প্রক্রিয়ার ধীর গতির ফলে মানুষের বিচার ব্যবস্থার প্রতি ভরসায় ধাক্কা লেগেছে।’’ আইনি প্রক্রিয়া মানলে, ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত ধরা পড়লে প্রথমে চিহ্নিতকরণ হবে। চার্জশিটের পর আদালতে বিচার শুরু হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে অভিযুক্তেরা আর্জি জানাতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও পর্যালোচনা ও সংশোধনের আর্জির সুযোগ রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড হলে প্রাণভিক্ষার আবেদনও জানানো যায়। এ কারণেই কি মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ছেন? সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, ‘‘দেশের সংবিধান, ভারতীয় দণ্ডবিধিতে অপরাধীর বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তা এ ভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। আইনের রক্ষকেরাই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: পুলিশের গুলিতেই ঝাঁঝরা চার অভিযুক্ত

বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ‘এনকাউন্টার’-এ অভিযুক্তদের নিকেশ করে হাততালি কুড়োনোর পিছনে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও রয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারের মতে, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চটজলদি সুবিচারের রাস্তা খুঁজছে। কিন্তু এর ফলে আগামী দিনে রাস্তায় ভিড় জড়ো করে পিটিয়ে মেরে ফেলাটাই সুবিচার বলে অনেকের মনে হবে। এতে সমাজে হিংসা বাড়বে। এমনিতেই গোরক্ষক বাহিনীর গণপিটুনি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বল সম্প্রদায়ের উপরে হামলা হচ্ছে।’’ আর করুণার যুক্তি, ‘‘পুলিশে লোকবল, পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের উপর বিপুল চাপ ছিল যে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হবে। আমরা তো জানিই না, যে চারজনকে পুলিশ অভিযুক্ত বলে গ্রেফতার করেছিল, তারাই আসল অপরাধী কি না। না কি আসল অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জন্যই আদালতে বিচারের দরকার।’’ কবিতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই হায়দরাবাদ পুলিশই প্রথমে ধর্ষিতার পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এখন তাদের ‘এনকাউন্টার’-কে সুবিচার হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু আদালতে বিচার হলে পুলিশের গাফিলতি ধরা পড়ত।

হায়দরাবাদের ‘এনকাউন্টার’-এর পরে অনেকেরই মত, এর ফলে ভবিষ্যতে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। অপরাধীরা ভয় পাবে। কিন্তু কবিতা কৃষ্ণনের প্রশ্ন, ২০০৮-এ হায়দরাবাদ পুলিশের হেফাজতে আটক তিন জন অ্যাসিড হামলায় অভিযুক্তকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তার পরে কি তেলঙ্গানা বা ভারতে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ কমেছে? মানবাধিকার কর্মীদের প্রশ্ন, উত্তরপ্রদেশে গত দু’বছরে যোগী আদিত্যনাথের জমানায় একের পর এক এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে কি অপরাধ কমেছে?

উন্নাওয়ে ধর্ষিতাকে জামিনে মুক্ত অভিযুক্তেরা জ্বালিয়ে দেওয়ার পর বিএসপি নেত্রী মায়াবতী আজ দাবি তুলেছেন, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ হায়দরাবাদ পুলিশকে দেখে শিখুক। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ পাল্টা জানিয়েছে, দু’বছরে রাজ্যে ৫,১৭৮টি ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে। নিহতর সংখ্যা ১০৩। আহত ১,৮৫৯ জন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভারের মত, ‘‘এই বন্দুকের বিচার মেনে নেওয়া যায় না। সরকার এর পর মহিলাদের নিরাপত্তার নামে যথেচ্ছ হিংসা শুরু করবে।’’

‘এনকাউন্টার’ ঘিরে এই উন্মাদনার পিছনে কোনও রাজনীতিও আছে কি? বিজেপি-র দিকে আঙুল তুলে মানবাধিকার কর্মী শবনম হাসমির মত, ‘‘বিজেপি এই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। নাগরিক বিতর্কে হিংসা ঢুকিয়ে ফেলে। রোজই এরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে, কাশ্মীর, এনআরসি, অযোধ্যার রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন পিছনে চলে যায়। অর্থনীতিতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়েও মানুষ প্রশ্ন তুলতে ভুলে যায়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement