নিজে গৃহহীন। তার আক্রমণের নিশানাও ছিল আশ্রয়হীন ফুটপাতবাসী অথবা বস্তির বাসিন্দারা। ষাটের দশকে মুম্বই শহরতলির আতঙ্কের আর এক নাম ছিল রামন রাঘব। তার কোনও স্থায়ী ঠিকানারও খোঁজ পায়নি পুলিশ। সম্ভবত পথেই দিন কাটাত এই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার।
রামনের জন্ম ১৯২৯ সালে, পুণে শহরে। তার শৈশব নিয়ে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। কোন পরিস্থিতি তাকে কুখ্যাত হত্যাকারী করে তুলেছিল, সে অধ্যায় এখনও অন্ধকারেই। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ অবধি সে অন্তত ৪২ জনকে খুন করেছিল।
সে সময়ে সেন্ট্রাল রেলওয়ে পরিচিত ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে নামে। এর রেললাইন বরাবর ঘিঞ্জি বস্তি এলাকা ছিল রামনের অপরাধের বিচরণক্ষেত্র। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিল, ১৯৬৬ সালে সে খুন করেছিল ২৩ জনকে। কিন্তু তার শিকারের মোট সংখ্যা কত, সেটা বলতে পারেনি। নিজেই নাকি ভুলে গিয়েছিল!
খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকা ফুটপাতবাসী বা বস্তির দরিদ্ররাই ছিল রামনের শিকার। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ভারী জিনিসের আঘাতে তাদের খুন করত সে। তার আগে পাঁচ বছর জেলবন্দি ছিল ডাকাতির ঘটনায়।
১৯৬৫-’৬৬ সাল নাগাদ পূর্ব মুম্বইয়ের শহরতলিতে সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনায় চাঞ্চল্য দেখা দেয়। অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর হাতে আহত হন অন্তত ১৯ জন। তাঁদের মধ্যে মারা যান ৯ জন। সে সময় ওই এলাকায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল এক ব্যক্তিকে। সন্দেহভাজনকে আটকের পর জানা যায় তার নাম রামন রাঘব এবং পুলিশের খাতায় তার নাম আগেও আছে।
কিন্তু সিরিয়াল কিলিংয়ের সঙ্গে তার কোনও যোগসূত্র প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ। ফলে সে বার রামন রাঘব ছাড়া পেয়ে যায়। দু’বছর পরে ফের সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে মুম্বই। এ বার রামন রাঘবের সন্ধানে চিরুনি তল্লাশি শুরু করে পুলিশ।
পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা রামকান্ত কুলকার্নির নেতৃত্বে একটি দল তল্লাশি শুরু করে রামন রাঘবের সন্ধানে। মূলত সাব ইনস্পেক্টর অ্যালেক্স ফিয়ালহোর কৃতিত্বে ধরা পড়ে রামন রাঘব। ফাইল ফোটোগ্রাফ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সাহায্যে গ্রেফতার করা হয় রামনকে। সিন্ধি ডালওয়ানি, আন্না, থাম্বি, তালওয়ানি, ভেলুস্বামী নামেও পরিচিত ছিল সে।
পুলিশের হাতে গ্রেফতারের সময় রামন রাঘবের কাছে ছিল একটি চশমা, একটি কাঁচি, দুটো চিরুনি, ধূপকাঠির স্ট্যান্ড, গুঁড়ো চা, রসুন, গাণিতিক হিসেবে ভরা দু’টি কাগজ। তার জামা এবং খাকি শর্টসে কাদার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল রক্তের শুকনো দাগ।
কিন্তু রামন রাঘবের কাছ থেকে তথ্য উদ্ধার করা ছিল কার্যত দুঃসাধ্য। পুলিশের কঠিন জেরাতেও তার মুখ ছিল কুলুপবন্ধ। শেষে চাবি খুলল চিকেন কারিতে। থালায় চিকেনের ঝোল পরিবেশন-সহ তার আরও কিছু ইচ্ছে পূরণ করা হয়েছিল। তার পর নিজেই কবুল করেছিল অপরাধের খুঁটিনাটি।
এর পর পুলিশকে নিয়ে মুম্বই শহরতলি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল রামন রাঘব। কোথায় কোথায় সে হত্যালীলা চালিয়েছিল, চিনিয়েছিল ঘাতক নিজেই। উত্তর মুম্বই শহরতলির এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা লোহার রড সে তুলে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। এটাই ছিল তার খুনের অস্ত্র। সেইসঙ্গে আরও জানা যায়, রামন রাঘবের অপরাধ শুরু হয়েছিল তার পরিবারেই। ধর্ষণের পরে একাধিকবার ছুরির আঘাতে নিজের বোনকে খুন করেছিল সে।
পুলিশের উদ্যোগে তার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণও হয়। মনোবিদরা জানান, মানসিক দিক দিয়ে রামন রাঘব সম্পূর্ণ সুস্থ। আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু শুনানি চলাকালীন ফের রামন রাঘবকে পরীক্ষা করেন সাইক্রিয়াটিস্টরা। তাঁরা জানান, রামন রাঘব ক্রনিক প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়ার শিকার। সঙ্গে এও বলা হয়, এই মানসিক পরিস্থিতি থেকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। প্রাণদণ্ড থেকে তার শাস্তি পরিবর্তিত হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে। কিডনি নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে ১৯৯৫ সালে তার মৃত্যু হয়।
রামকান্ত কুলকার্নির লেখা বই ‘ক্রাইমস ক্রিমিনালস অ্যান্ড কপস’-এ রামন রাঘবের উপর বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য আছে। জেরায় এই সিরিয়াল কিলার বলেছিল, সে নিজেকে আইনের জগতের প্রতিনিধি বলে মনে করে। তার চারপাশে বাকিরা সবাই অন্য দুনিয়ার লোক।
সে কারণে নাকি সবাই তার লিঙ্গ পরিচয় পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে। অভিযোগ ছিল রামন রাঘবের। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ রামন রাঘব ছিল কানুন বা আইনের দুনিয়ার প্রতিনিধি। নিজেকে শক্তির প্রতীক বলেও মনে করত সে।
আরও একটি অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল তার। সে মনে করত, চারপাশের সবাই তার সঙ্গে সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত হতে চায়। আর সেটা করলেই, অর্থাৎ কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলেই নাকি সে মহিলা হয়ে যাবে। এটাই ছিল রামন রাঘবের স্থির বিশ্বাস।
তার বৈচিত্রময় জীবন বার বার বিষয় হয়ে উঠে এসেছে অভিনয় মাধ্যমে। তাকে নিয়ে শর্ট ফিল্ম বানিয়েছেন শ্রীরাম রাঘবন। মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রঘুবীর যাদব। অনুরাগ কাশ্যপের পরিচালনায় ‘রামন রাঘব ২.০’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। (ছবি: আর্কাইভ ও শাটারস্টক)