ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের আড়াই ডজন প্রকল্পের কাজ যে খরচের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। দু’ডজনের বেশি প্রকল্পের কাজ যে সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আর গোটা চোদ্দো প্রকল্পের কাজ সময়ের মধ্যেও শেষ করা যায়নি, খরচও বেড়ে গিয়েছে।
কলকাতায় মেট্রো রেলের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কলকাতা বিমানবন্দরের নতুন এটিসি টাওয়ার, খড়্গপুরের এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট বা রাণীগঞ্জ মাস্টার প্ল্যান, পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ৭২টি বড় মাপের প্রকল্পের কাজ চলছে। যে সব প্রকল্পের খরচ ১৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি। বাজেটের আগে কোন প্রকল্পে কতখানি বরাদ্দ করা দরকার, তার হিসেব-নিকেশ হয়। কোন প্রকল্প শেষ করতে কত টাকা দরকার, কোন প্রকল্পের আর এগোনো যাচ্ছে না, সেই অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়ানো হয় বা ছাঁটাই হয়।
এ বার এই হিসেব-নিকেশ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ওই ৭২টি প্রকল্পের মধ্যে ৩০টি প্রকল্পের খরচ প্রথমে যা ধরা হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি খরচ হবে। প্রায় ৬২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রকের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য বলছে, কাজ শুরুর সময়ে এই ৩০টি প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার কম। এখন অনুমান, খরচ বেড়ে ৪৮ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। ২৭টি বড় মাপের প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়নি। সরকারি অনুমান অনুযায়ীই, কোথাও চার মাস, কোথাও সাতাশ বছর বছর বেশি সময় লাগবে বলে ধরা হচ্ছে। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ার ফলেও এই প্রকল্পগুলির খরচ বাড়বে।
রাজ্যের ১৪টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে সময় ও খরচ দুই-ই বেশি লাগছে। কলকাতায় মেট্রোর যাবতীয় প্রকল্পই এই তালিকায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমান, নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর, জোকা-বিবাদী বাগ, বরানগর-ব্যারাকপুর—এই সব মেট্রো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে ২০২৫ হয়ে যাবে। পরে সেই সময়সীমাও বাড়তে পারে। যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম উপদেষ্টা অমিতাভ রায় বলেন, “এর ফলে যে অংশের কাজ শেষ হয়ে পড়ে থাকছে, পুরো কাজ শেষ হয়ে প্রকল্প চালু না হওয়া পর্যন্ত ওই অংশটা অব্যবহৃত পড়ে থাকছে। জল-বৃষ্টিতে তার প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। সেটা হিসেবের মধ্যে ধরা হচ্ছে না।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে এই ১৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পের অগ্রগতির দিকে নিয়মিত নজরদারি করেন। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যের সংস্থাগুলির সঙ্গে ‘প্রগতি’ নামের ভিডিয়ো কনফারেন্স করেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রের খবর, মোদী একাধিক বার কাজের সময়সীমা ও ব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, আগের তুলনায় উন্নতি হলেও এখনও হাল শোধরাতে অনেক দেরি। পশ্চিমবঙ্গের ৭২টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট আনুমানিক খরচ ছিল ৬৩,১২৯ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে ৮১ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে বলে অনুমান। ডিসেম্বরের পরে ওই ৭২টি প্রকল্পের মধ্যে একমাত্র চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে।
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। গোটা দেশেরই একই হাল। ১৫০ কোটি টাকার বেশি খরচের মোট ১,৬৭৯টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে ৫৪১টি প্রকল্পের কাজ সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি। ৪৩৯টি প্রকল্পে হিসেবের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হতে চলেছে। এ সব প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ছিল ২২.২৯ লক্ষ কোটি টাকা। এখন অনুমান, কাজ শেষ করতে অন্তত ২৬.৬৭ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হবে।
কেন এই হাল? পরিসংখ্যান মন্ত্রকের প্রকল্প নজরদারি বিভাগের কর্তারা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ, পরিবেশের ছাড়পত্র পেতে দেরি, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব, দরপত্র, বরাতে দেরি, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, কাজ করতে গিয়ে আচমকা প্রাকৃতিক সমস্যা তৈরি, দখল, কর্মীর অভাবের মতো বিভিন্ন কারণে কাজের দেরি হয়। এর সঙ্গে কোভিডের সময়ে লকডাউনের ফলে কাজের দেরি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ সূত্রের বক্তব্য, এই সমস্যার সমাধানে নতুন একটি ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে আগে থেকেই টের পাওয়া যাবে, কোন কাজ সময়ের মধ্যে শেষ হবে না, কোথায় খরচ বেশি হবে। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রককে আগেভাগে সতর্ক করা হবে। যাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা যায়।