ছবি: রয়টার্স।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে নাম না করে সন্ত্রাসে পাক মদতের কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আজ নিজের বক্তৃতায় তিনি বললেন, কোনও দেশ যেন আফগানিস্তানের স্পর্শকাতর পরিস্থিতিকে নিজেদের রাজনৈতিক অস্ত্র করে তুলতে না পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত কাবুলের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মোদী আহ্বানও জানালেন বিশ্ববাসীকে।
আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী নাশকতার আশঙ্কার কথা প্রত্যাশা মতোই মোদীর আজকের বক্তৃতায় উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি চিনের নাম উল্লেখ না করেও সমুদ্রপথকে সম্প্রসারণবাদ থেকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছেন মোদী। বস্তুত, নিউ ইয়র্কে যাওয়ার আগে এই দু’টি বিষয় নিয়েই ওয়াশিংটনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চতুর্দেশীয় অক্ষ কোয়াড নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন মোদী।
তবে আজ রাষ্ট্রপুঞ্জে মোদীর বক্তৃতায় ভারতের কৌশলগত আশঙ্কার থেকেও বেশি জায়গা করে নিয়েছে তাঁর সরকারের গত এক-দেড় বছরের কাজের খতিয়ান। তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে জাতীয় বিমা সুরক্ষা থেকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কথা বলেছেন তিনি। বস্তুত, এই সব কথাই মোদীকে গত এক বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মঞ্চে বলতে শোনা গিয়েছে। সঙ্ঘ নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের যে আজ জন্মদিন, তা উল্লেখ করে বক্তৃতায় গোড়াতেই মানবসেবার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের দর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন মোদী। ভারত যে গণতন্ত্রের মাতৃস্বরূপ, তা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে গিয়ে নিজের শৈশবে স্টেশনে চায়ের স্টলে বাবাকে সাহায্য করার কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন, “সেই বালকটি আজ চতুর্থ বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকেছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, হ্যাঁ, গণতন্ত্রে এ সব সম্ভব।” সর্বোপরি বিশ্বকে আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারত আবার অন্যান্য দেশকে প্রতিষেধক পাঠানো শুরু করেছে। গোটা বিশ্বের প্রতিষেধক নির্মাতাদের প্রতি তাঁর আহ্বান, “আপনারা ভারতে এসে কোভিডের প্রতিষেধক তৈরি করুন।”
রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, বিদেশনীতি জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে জাতীয় নীতিরই বর্ধিত অংশমাত্র। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ফায়দা তোলার বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। সব সরকারই কম-বেশি তা করে থাকে। মোদী সরকারের সামনে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের ভোট, যা কার্যত তাদের অগ্নিপরীক্ষা। উত্তরপ্রদেশের ভোট-প্রচারে ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে মেরুকরণের রাজনীতি, তালিবান-প্রসঙ্গ কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার চেষ্টা। বিরোধী শিবির সেই প্রেক্ষাপটেই আজ রাষ্ট্রপুঞ্জে মোদীর বক্তৃতাটিকে দেখতে চাইছে। যেহেতু এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেওয়া বক্তৃতা, তাই প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে এখনও মুখ খোলেননি বিরোধীরা। কিন্তু ঘরোয়া ভাবে বলা হচ্ছে, নিজের চা-বিক্রেতা সংক্রান্ত ‘পরিচয়ের রাজনীতি’-কে ফের
সামনে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের গরিমা প্রচার— কার্যত উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের সঙ্গেই এ দিন নিজেকে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন মোদী। তাঁর বক্তৃতাটিও ছিল হিন্দিতেই।
বিদেশ মন্ত্রক অবশ্য বলছে, মোদী ভারতের গণতন্ত্রের মহিমাকে আজ বিশ্বমঞ্চে জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ করতে কঠোর বার্তা দিয়েছেন প্রতিবেশীকে। কোভিড মোকাবিলায় সবাইকে একজোট করতে সচেষ্ট থেকেছেন। প্রগতি এবং বিকাশের এক নতুন ভারতকে জগৎসভায় ফের পরিচিত করিয়েছেন। মোদীর কথায়, “পশ্চাদমুখী চিন্তা এবং মৌলবাদের বিপদ গোটা বিশ্বে বাড়ছে।… ওই মানসিকতাযুক্ত যে দেশ সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে, তারা এ বার এটা বুঝুক যে, এই সন্ত্রাসবাদ তাদের নিজেদের জন্যই সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।” এর পরে সরাসরি আফগানিস্তান প্রসঙ্গ তুলে মোদী বলেন, “আফগানিস্তানের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে কোনও দেশ যাতে সন্ত্রাসবাদী হামলা না চালাতে পারে, তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। ওখানকার স্পর্শকাতর পরিস্থিতিকে যেন রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার না করা হয়। আফগানিস্তানের মহিলা, শিশু, সংখ্যালঘু এবং সব সাধারণ মানুষের সহায়তা জরুরি। আমাদের সবাইকে সেই দায়িত্ব পালন করতেই হবে।”
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত আধিপত্যের দিকে ইঙ্গিত করে মোদী বলেন, “সমুদ্রপথের সম্পদ সকলের ব্যবহারের জন্য। অপব্যবহারের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এটি জীবনরেখা বিশেষ। একে সম্প্রসারণবাদ এবং একাধিপত্যের হাত থেকে বাঁচিয়ে এখানে আন্তর্জাতিক আইনের শাসন প্রবর্তন করতে হবে। সেই কারণে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একসুরে আওয়াজ তোলা।”
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্কারের প্রশ্নে এর আগেও একাধিক বার সরব হতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। আজ দু’বছর পরে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্রপুঞ্জকে প্রাসঙ্গিক রাখতে গেলে তার কার্যকারিতা বাড়াতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলা ছায়াযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, উষ্ণায়ন সংক্রান্ত সঙ্কট, কোভিডের সময়ে এই প্রশ্ন উঠেছে। আফগানিস্তানের ঘটনায় এই প্রশ্ন গভীর হয়েছে।” একই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাঙ্কের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও তাঁর বক্তৃতায় প্রশ্ন তুলেছেন মোদী।