ভারতবর্ষ বরাবরই বিদেশিদের কাছে ‘সোনার পাখি’। ইতিহাস বলছে, সম্পদের খোঁজে বারবার ভারতে হানা দিয়েছে বিদেশি শক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াও লুঠতরাজের অন্যতম নিশানা ছিল ভারতীয় রাজ পরিবারগুলির অমূল্য সম্পদ। তাঁদের কোষাগারে কী বিপুল পরিমাণ সম্পদ ছিল, তা কিছুটা হলেও বোঝা যায় রাজপরিবারের সদস্যদের অলঙ্কার ভাণ্ডার দেখে। যদিও তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র।
মহারাজা দলীপ সিংহের শেরপেচ : পাগড়ির গয়নাকে বলে ‘শেরপেচ’। শিখ সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন মহারাজা দলীপ সিংহ। তাঁর পোর্ট্রেটে দেখা যায় পাগড়ির উপর হিরের বহুমূল্য এই গয়না। উপরের তিনটি শিখি সমেত পুরো অলঙ্কারটাই গাঁথা হিরে দিয়ে। বিশাল আকারের একটি পান্নাকে ঘিরে গাঁথা হয়েছিল হিরেগুলিকে।
মহারাজা ভূপিন্দর সিংহর পাতিয়ালা নেকলেস : বিখ্যাত ফরাসি সংস্থা ‘কার্তিয়ের পারি’-কে দিয়ে ১৯২৮ সালে এই কণ্ঠহার তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজা ভূপিন্দর সিংহ। পাঁচ ছড়ার এই নেকলেস বানাতে প্রয়োজন হয়েছিল মোট ২৯৩০ টি হিরে। কণ্ঠহারের মাঝে লকেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম হিরে। ২৩৪ ক্যারাটের ‘ইয়েলে ডি বিয়ার্স’। এ ছাড়াও এই গয়নায় আছে প্ল্যাটিনাম, টোপাজ এবং চুনি-সহ আরও বহু দুর্মূল্য রত্ন।
পাতিয়ালা চোকার : চুনি দিয়ে গাঁথা এই কণ্ঠ অলঙ্কার ছিল পাতিয়ালার মহরারানির। ঐতিহাসিক এই অলঙ্কারও ছিল ফরাসি সংস্থা কার্তিয়ের-এর তৈরি। ১৯৩১ সালের এই প্ল্যাটিনাম চোকারে চুনি ছাড়াও ছিল অজস্র হিরে আর মুক্তো। এই অমূল্য উপহার ছিল মহারানি ভক্তওয়র কউর সাহিবাকে দেওয়া ভূপিন্দর সিংহের উপহার।
কাশ্মীরি রাজকুমারির ডাইয়াডেম : মুকুট আর টিয়ারা বা টায়রার মাঝামাঝি এই গয়না ভারতীয় ইতিহাসে বেশ প্রাচীন। কাশ্মীরি রাজপরিবারে যেটি ছিল, তা নবম শতাব্দীর তৈরি। মূলত কাশ্মীরি মেয়েরা কপালের উপর পরে এই গয়না। কাশ্মীরি রাজ পরিবারের গয়নায় খোদিত আছে চারজন কিন্নরীর অবয়ব।
ভদোদরার রানির হিরের নেকলেস : তিন ছড়ার এই হিরের হার ছিল রানি সীতাদেবীর। ভদোদরার ‘গায়কোয়াড়’ মূলহার রাও উনিশ শতকে এই অলঙ্কার কিনেছিলেন তৎকালীন বাজারের হিসেবে প্রায় দু’ কোটি টাকায়। কণ্ঠহারের মূল আকর্ষণ ১২৮ ক্যারাটের ‘স্টার অব সাউথ’ ডায়মন্ড এবং ৭৮.৫ ক্যারাটের ‘ইংলিশ ড্রেসডেন ডায়মন্ড’। পরবর্তী কালে এই গয়না হাতবদল হয়ে আবার ফিরে যায় নির্মাতা কার্তিয়ের-এর কাছেই।
ভদোদরার মুক্তোহার : সাত ছড়ার এই কণ্ঠহার পুরোটাই গাঁথা হয়েছিল প্রাকৃতিক মুক্তো দিয়ে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ভদোদরার মহারাজা খান্ডে রাও গায়কোয়াড় এই অলঙ্কার বানিয়েছিলেন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ১৬০ বছর পরেও তাঁর জৌলুস একবিন্দুও কমেনি।
নওয়ানাগড়ের পান্নাহার : আজকের গুজরাতের জামনগরে ছিল এই নেটিভ এস্টেট। নওয়ানাগড়ের মহারাজা বানিয়েছিলেন এই কণ্ঠহার। দুর্মূল্য এই কণ্ঠহারে ছিল ২৭৭ ক্যারাটের মোট সতেরোটি চৌকো পান্না। বলা হয়, এই কণ্ঠহার কোনও এক সময়ে ছিল তুরস্কের সুলতানের কোষাগারে।
ভূপিন্দর সিংহের শেরপেচ: পাতিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দর সিংহের সংগ্রহের আরও একটি অলঙ্কার। আদ্যোপান্ত হিরের তৈরি এই পাগড়ি-সজ্জা পরে নিলাম হয়েছিল এক লক্ষ সত্তর হাজার মার্কিন ডলারে। এই অলঙ্কারগুলির বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশরা নিয়ম করেছিল কোনও নেটিভ স্টেটের মহারাজা ইংলিশ ক্রাউন পরতে পারবেন না। তার জেরেই বিশেষ গুরুত্ব পায় এই শেরপেচ বা পাগড়ির গয়না।
শুধু সাজসজ্জাই নয়। অলঙ্কার ছিল প্রতিটি রাজপরিবারের পরিচয় ও ঐতিহ্য। গঠনশৈলিতে স্বকীয়তা বজায় রাখতে চেষ্টার কসুর করতেন না রাজারা। সারা বিশ্ব থেকে আনা হত শ্রেষ্ঠ রত্নসম্ভার। ভারতীয় রাজপরিবারের অনেক প্রাচীন অলঙ্কারই আজ সাজানো আছে বিদেশি মিউজিয়মে বা কোনও বিশেষ ধনকুবেরের সংগ্রহশালায়।