—ছবি সংগৃহীত।
জ্বালানির (বিশেষত ডিজেলের) চড়া দাম। নোটবন্দি, জিএসটির ‘ক্ষত’। কোভিড, লকডাউনে ছিঁড়ে যাওয়া জোগান-শৃঙ্খল। সরকারি নীতির ‘গলদে’ মজুতদারির প্রবণতা বৃদ্ধি। দু’বেলা দু’মুঠো খেতে বসে নিতান্ত সাধারণ খাবারের দামেও যে হেঁচকি ওঠার জোগাড়, তার জন্য ‘কাঠগড়ায় আসামির’ সংখ্যা নেহাত কম নয়।
সর্ষের তেল ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ হাঁকিয়েছে। মাছ-মাংস-দুধ, এমনকি আনাজ অগ্নিমূল্য। মোদী সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এক সময়ে ‘থালি ইকনমিক্সের’ কথা বললেও, খাবারের পাতে যেন দামের ছেঁকা। এর প্রথম কারণ হিসেবে অবশ্যই জ্বালানির চড়া দরকে দোষী ঠাওরাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির কথায়, ‘‘বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দর সামান্য বাড়তেই চড়া শুল্কের জেরে দেশে পেট্রল, ডিজেলের দাম বেড়েছে বহু গুণ। ফলে বেড়েছে কৃষিপণ্য পরিবহণের খরচও। তার প্রভাব পড়ছে খাবারের পাতে।’’
শুধু পরিবহণ খরচ নয়, তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে চাষের খরচ সামগ্রিক ভাবেই বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। অর্থনীতির অধ্যাপক শুভনীল চৌধুরীর কথায়, ‘‘ডিজেল দামি হওয়ায় সেচের খরচ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের জেরে দাম চড়েছে সার, কীটনাশকের।’’ দিব্যেন্দুর মতে, একশো দিনের কাজের মতো প্রকল্প চালু করার জেরে বেশ খানিকটা বেড়েছে চাষের কাজে ন্যূনতম মজুরিও। ফলে সব মিলিয়ে, চাষবাসের খরচ বেড়ে গিয়েছে অনেকখানি।
আইডিএসকে-র ডিরেক্টর, অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন, চাষের মাঠ থেকে যে পথ ঘুরে খাবার শেষমেশ পাতে এসে পৌঁছয়, কোভিড এবং লকডাউনে ছিঁড়ে গিয়েছে সেই জোগান-শৃঙ্খলই। তাঁর কথায়, ‘‘এই শৃঙ্খলের বেশির ভাগ অংশই এখনও অসংগঠিত ক্ষেত্রের আওতায়। জিএসটি চালুর সময় থেকে চেষ্টা হয়েছে জোর করে দ্রুত তাকে সংগঠিত ক্ষেত্রের আওতায় নিয়ে আসতে। তাতে নষ্ট হয়েছে তার নিজস্ব ছন্দ। ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে ওই শৃঙ্খল। আবার ওই ‘চোট’ সামলানোর আগেই সব তছনছ করে দিয়েছে কোভিড এবং লকডাউন।’’ তাঁর মতে, এই পরিস্থিতি পুরোদস্তুর ঠিক হওয়া তো দূর, বরং সমস্যা এখনও বহাল বিভিন্ন রাজ্যে আংশিক লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ বজায় থাকার কারণে। তথ্যও বলছে, গত বছর পূর্ণ লকডাউনে হোটেল-রেস্তরাঁ টানা বন্ধ থাকার সময়ে সেখানে মুরগির মাংস কিংবা ডিম জোগানো ব্যবসায়ীরা সেই যে লগ্নি কিংবা ব্যবসার বহর কমিয়েছেন, তা আগের জায়গায় ফেরেনি এখনও। এই একই কথা সত্যি আরও বহু কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে।
কেন বাড়ছে দাম
• কৃষিপণ্য ক্ষেত্রে আরও বেশি করে কর্পোরেট দুনিয়ার পা রাখা, চুক্তি-চাষ এবং আগাম লেনদেনের বাজারও দাম বৃদ্ধির কারণ।
• গত বছর মার খাওয়া বিক্রিবাটার ক্ষতি এখন দাম বাড়িয়ে পুষিয়ে নিতে চাইছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ।
• দূষণে খামখেয়ালিপনা বেড়েছে প্রকৃতির। অনিয়মিত বৃষ্টির প্রভাব চাষে।
• আইএমএফের মতে, খাদ্যপণ্যের দাম বেলাগাম ভাবে বাড়ছে সারা পৃথিবীতেই। বিশেষত বিপদে ভারত-সহ উন্নয়নশীল দেশগুলি।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে খাদ্যপণ্যের দর বাড়ছে বিশ্ব জুড়ে। উপদেষ্টা সংস্থা নোমুরা-র দাবি, খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুত ওঠা-নামার নিরিখে বিশ্বে ভারত প্রথম পঞ্চাশে। কিন্তু তবু খাবারের দাম বেলাগাম হওয়ায় প্রশ্নের মুখে সরকারের নীতিও। শুভনীলের মতে, কৃষিপণ্যে কর্পোরেটের পায়ের ছাপ যত স্পষ্ট হচ্ছে, তত তার দাম বাড়ছে রকেট গতিতে। এ জন্য সবার আগে সর্ষের তেলের দরের উদাহরণ তুলে ধরছেন তিনি। মূল্যায়ন সংস্থা ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চেরও দাবি, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত চাল-গমের মতো খাদ্যশস্যে গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ৩.৪% হলেও, প্যাকেটবন্দি খাদ্যে তা ৭.২%।
খাদ্যপণ্য, বিশেষত ডাল, ভোজ্য তেলের চড়া দাম যে সরকারের মাথাব্যথার কারণ, তা মানছেন আমলারাও। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, খাদ্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে বলেই অগস্টে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ৫.৩ শতাংশে নেমেছে।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এ বার এই হার কিছুটা কম দেখাচ্ছে গত বারের বেশি দরের সাপেক্ষে হিসেবের কারণে। করোনার ধাক্কার আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে খুচরো পণ্যের বাজারে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮৯%। ২০২০ সালের অগস্টে তা পৌঁছেছিল ৯.০৫ শতাংশে। তাই এ বছর অগস্টে তুলনায় নিচু হারের মূল্যবৃদ্ধি এক বছর আগের উঁচু দামের নিরিখে হিসাব কষার ফল।
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, ভোজ্য তেলের দাম কমাতে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। ডালের দাম কমাতে বিদেশ থেকে তা আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী সরকারের ‘বন্ধু’ ব্যবসায়ীদের ফায়দা পাইয়ে দিতেই যথেচ্ছ হারে দাম বাড়ানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কারণ এই সব ব্যবসায়ীই বিজেপিকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল চাঁদা দিচ্ছেন। কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতে বলেন, ‘‘মোদী সরকার অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের যত ইচ্ছে খাদ্যপণ্য মজুতের খোলা মাঠ দিয়েছে।’’ অর্থনীতির অধ্যাপকরাও অনেকেই বলছেন, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করে সরকার ‘কথা দিয়েছে’, এক বছরের মধ্যে দর দেড়-দু’গুণ না হলে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না তারা। প্রশ্ন উঠছে, এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পরে কেনই বা নিশ্চিন্তে দাম বাড়ানোর পথে হাঁটবেন না ব্যবসায়ীরা? সেই সঙ্গে, অচিনের মতে, ‘‘চুক্তি-চাষ এবং আগাম লেনদেন এখনও কৃষিপণ্যের দরে বিরাট ফারাক তৈরি করেনি ঠিকই, কিন্তু তা ওই বিষয়ে অনুঘটকের কাজ করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।’’
এক দিকে, টোম্যাটোর দাম না পেয়ে রাস্তায় ফসল ফেলে দিচ্ছেন চাষি। অন্য দিকে একই সময়ে, শহরের বাজারে তার দর চড়া! সম্প্রতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এমন ছবি উঠে এসেছে একাধিক বার। ফলে প্রশ্ন, তবে কি চাষিরা কম দর পেলেও খাবারের দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের ‘মার্জিন বৃদ্ধির’ কারণে? আসলে চড়া লাভ ব্যবসায়ী ও ফড়েদের?
কাঠগড়ায় খামখেয়ালি আবহাওয়াও। জেএনইউ-এর অর্থনীতির অধ্যাপক সৌমেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনিয়মিত বৃষ্টিও আনাজের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী।’’ তা ছাড়া তাঁর মতে, বাজারে বিক্রিবাটা আগের থেকে কমে যাওয়ায় কিছুটা দাম বাড়িয়ে আগের আয়টা অন্তত ধরে রাখতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা।
এত কারণের ‘আক্রমণে’ খাদ্যপণ্যেরও যেন অভিমন্যুর চক্রব্যূহে আটকে পড়ার দশা।