চিনের গোপন নজরদারিতে প্রায় সব ক্ষেত্রের হাই প্রোফাইলরা।
গালওয়ান সঙ্ঘাতের প্রেক্ষিতে তিন দফায় শতাধিক চিনা অ্যাপ বাতিল করেছে ভারত। নরেন্দ্র মোদী সরকারের অভিযোগ ছিল, ওই সব অ্যাপ ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক। পূর্ব লাদাখে এখনও চলছে ভারত-চিন সঙ্ঘাত। এমন পরিস্থিতিতে চিনা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি ভারতের বহু বিষয়ে নজরদারি চালাচ্ছে বলে দাবি করেছে একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক। তাদের বক্তব্য, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অন্তত ১০ হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব (যাঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকরও আছেন) এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উপর নজরদারি চালাচ্ছে শেংঝেনের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা।
ঘটনাচক্রে, ওই সংস্থাটি তথ্য সরবরাহ করে চিন সরকার, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি, চিনের সেনা-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকেও। ফলে তাদের নজরদারি-প্রসূত সেই তথ্য বেজিংয়ের হাতেও পৌঁছেছে বলে আশঙ্কা করছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকদের।
‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর ওই তদন্তমূলক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনীতি থেকে বিনোদন, ক্রীড়া থেকে সংবাদমাধ্যম— এমনকি, অপরাধী ও জঙ্গিদের সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছে দক্ষিণ পশ্চিম চিনের গুয়াংডং প্রদেশের শেনঝেন শহরের ‘শেনহুয়া ডেটা ইনফরমেশন টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড’ নামে ওই সংস্থা। তাদের অন্যতম ‘ক্লায়েন্ট’ শি চিনফিং সরকার, চিনের সেনাবাহিনী পিপল্স লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) এবং চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও ওই সংস্থার কেউ সংবাদপত্রের তরফে পাঠানো কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি। সংস্থার এক আধিকারিক ব্যাপারটি ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে বিশদ মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন: সেনার পাশে থাকার বার্তা দেবে সংসদ, অধিবেশনের আগে লাদাখ নিয়ে আশা মোদীর
তদন্তমূলক প্রতিবেদনটির দাবি, নজরদারির তালিকায় রয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কংগ্রেসের অন্তর্বর্তীকালীন সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-সহ শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রাজনাথ সিংহ, নির্মলা সীতারামন, স্মৃতি ইরানি, পীযূষ গয়ালের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও নজরদারির আওতায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা-সহ ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, রাজস্থানের অশোক গহলৌত, মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরে, পঞ্জাবের অমরেন্দ্র সিংহের মতো অনেক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তথ্যও সংগ্রহ করছে ওই সংস্থা। প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে, রতন টাটা, গৌতম আদানির মতো শিল্পপতি এবং বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক, ইউপিএ আমলে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু এবং বিভিন্ন সাংবাদিক ও সংবাদব্যক্তিত্বও রয়েছেন ওই সংস্থার আতসকাচের তলায়। এঁদের মধ্যে অনেকের পরিবারের সদস্যদের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে বলে দাবি। রয়েছে ডিএমকে, বিএসপি, আরজেডি-র মতো রাজনৈতিক দলের গতিবিধির তথ্য। যেমন রয়েছে সচিনের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটারের তথ্যও। প্রতিবেদনের আরও দাবি— জঙ্গি, চোরাকারবারি, অপরাধীদের কার্যকলাপের তথ্যেও পূর্ণ এই চিনা সংস্থার তথ্যভাণ্ডার।
আরও পড়ুন: ‘নিজেদের জীবন নিজেরা বাঁচান, প্রধানমন্ত্রী ময়ূর নিয়ে ব্যস্ত’, কটাক্ষ রাহুলের
এই ব্যক্তিদের কাজকর্ম, তাঁদের গতিবিধি-সহ যাবতীয় তথ্য প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করছে শেনহুয়ার ওই সংস্থা। তথ্যসংগ্রহের উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, গবেষণাপত্র, প্রতিবেদন বা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির মতো বহুবিধ বিষয়। শেনহুয়ার নিজস্ব ‘মনিটরিং ম্যাপ’ও রয়েছে। সংস্থার পরিভাষায় যা হল ‘পার্সন ইনফর্মেশন অ্যান্ড রিলেশনশিপ মাইনিং’। শেনহুয়ার ওয়েবসাইটে রয়েছে ‘ওভারসিজ কি ইনফরমেশন ডেটাবেস’ (ওকেআইডিবি)। প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, গত প্রায় দু’মাস ধরে সংস্থার ‘মেটা ডেটা’ ও ‘লগ ফাইল’ ঘেঁটে তথ্য বার করেছে তারা। দেখা গিয়েছে, শুধু ভারত নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো বহু দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যও সংগ্রহ করে শেনহুয়া।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার ২০টি প্রসেসিং সেন্টার রয়েছে বিভিন্ন দেশে। গত ১ সেপ্টেম্বর সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া ই-মেলে এই সংক্রান্ত প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’। কিন্তু কোনও জবাব আসেনি। উল্টে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে শেনহুয়ার ওয়েবসাইট দেখা যাচ্ছে না। ওই সংবাদপত্রের এক প্রতিনিধি সংস্থার শেনঝেনের প্রধান কার্যালয়েও গিয়েছিলেন। এক আধিকারি তাঁকে বলেন, ‘এই সব প্রশ্ন ব্যবসায়িক গোপনীয়তার পরিপন্থী। তাই প্রকাশ করা যাবে না।’
তবে নয়াদিল্লিতে চিনা রাষ্ট্রদূতের অফিসের একটি সূত্র বলেছে, ‘‘খিড়কিরদরজা দিয়ে বা স্থানীয় আইন ভেঙে চিনের বাইরের তথ্য চিনের সরকার কখনও কোনও সংস্থা বা ব্যক্তির কাছ থেকে নেয় না।’’ তবে শেনহুয়ার কাছ থেকে তথ্য নেওয়া সম্পর্কিত সরাসরি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে ওই সূত্র।
গত ৪ মে থেকে পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় বিপুল সেনা মোতায়েন করেছে চিন। তার জেরে ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় দু’পক্ষের সেনা সংঘর্ষে ভারতের ২০ জওয়ানের মৃত্যু এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রমের উপর নজর রাখলে এটা অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় বলেই মনে করছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল। বিশেষত, শেনহুয়া যখন দাবি করছে, তারা শি চিনফিং সরকার এবং সে দেশের সেনার সঙ্গে কাজ করে। যদিও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরার সাইবার সিকিউরিটি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ রবার্ট পটারের মতে, ‘‘প্রত্যেক দেশই এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এটা বিদেশ সংক্রান্ত গোয়েন্দাদের কাজ। কিন্তু বিপুল পরিমাণ তথ্য ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে চিন সেটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।’’