প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলি লাগাতার দাবি করে আসছে, দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করে মোদী সরকার বিরোধীদের দাবিয়ে রাখতে চায়। সব বিরোধী দলই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির ‘অতি সক্রিয়তা’ নিয়ে সরব। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু আজ ফের বললেন, ‘‘যাদের স্বার্থে আঘাত লাগছে তারা তো চেঁচাবেই। যাদের পা কাদায় আটকে রয়েছে তারা চিৎকার করবেই। দুর্নীতিগ্রস্তরা যতই ক্ষমতাশালী হোক, তারা যেন ছাড় না পায়।”
দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে আজ কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের একটি অনুষ্ঠান ছিল। সব কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অফিসারেরাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গত মাসে রাজকোটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই তারা চিৎকার করে। আজ সেই সুরই আরও চড়া করে তিনি অফিসারদের উদ্দেশে বললেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনাদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আপনারা দেশের ভালর জন্য কাজ করছেন, অপরাধ করছেন না।’’
মোদী যখন এই বার্তা দিচ্ছেন, দেশ জুড়ে তখন বিরোধী দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা চলছে, কেউ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পাচ্ছেন, তো কেউ জেলে। তৃণমূল, আপ, কংগ্রেস, এনসিপি, শিবসেনা, আরজেডি, জেএমএম, ন্যাশনাল কনফারেন্স— কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নিশানার বাইরে নেই কেউই। সনিয়া-রাহুল গান্ধী থেকে সত্যেন্দ্র জৈন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত সরেন— তদন্তের আতশকাচের তলায় সকলেই। বিরোধীদের দাবি, যেখানে বিরোধী সরকার রয়েছে সেখানে সরকার ফেলতে, যেখানে সরকার নেই সেখানে কণ্ঠরোধ করতে সিবিআই-ইডি লেলিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্র।
নিজের উদাহরণ টেনে মোদীর কিন্তু বক্তব্য, “আমি দীর্ঘ সময় গুজরাতের প্রশাসনের নেতৃত্ব দিয়েছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় বহু গালিগালাজ শুনেছি। কিন্তু জনতা ঈশ্বরের মতো। আপনি সৎ রাস্তায় চললে দেশবাসী আপনার পাশে থাকবে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।” ঘটনাচক্রে আজই গুজরাতের ভোট ঘোষণা হল। সেতু দুর্ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে মোদী অবশ্য কিছু বললেন না।
আজ বক্তৃতায় দুর্নীতি দমনে তাঁর সরকারের ভূমিকার কথাই বিশদে বলেছেন মোদী। সেই সঙ্গে ফের তোপ দেগেছেন কংগ্রেসের দিকে। মোদীর কথায়, “স্বাধীনতার পরেও ভ্রষ্টাচার, শোষণ, সরকারি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো বিষয়গুলি ক্রমশ বেড়ে গিয়েছে। ভারতের চারটি প্রজন্ম তা সহ্য করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার এই অমৃতকালে দশকের পর দশক জুড়ে চলা দুর্নীতির পরম্পরা আমাদের শেষ করতে হবে। কোনও রাজনৈতিক অথবা সামাজিক আশ্রয় যেন দুর্নীতিবাজেরা না পায়, এমন বাতাবরণ তৈরি করতে হবে।”
বিরোধীদের পাল্টা দাবি, দুর্নীতির অভিযোগ বারবার তুলে কংগ্রেসকে আক্রমণ তো করেনই মোদী। ছাড় পায় না বিরোধী অন্য দলগুলোও। কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে ওঠা কোনও দুর্নীতির অভিযোগই আমল পায় না। যেমন, আজ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, “আমি দেখেছি হাজতবাস করা অপরাধীরও গৌরবগান করা হচ্ছে। তার সঙ্গে ছবি তোলার হুড়োহুড়ি। লজ্জাও হয় না!” বিরোধীদের প্রশ্ন, এই লজ্জার প্রসঙ্গ কোথায় থাকে যখন বিলকিস বানো মামলায় অপরাধীদের ফুল-মিষ্টি দেওয়া হয়?
প্রতিরক্ষা দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “দশকের পর দশক ধরে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। তার কারণ আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সব ছিল বিদেশ নির্ভর। আজ আত্মনির্ভরতা বাড়ায় দুর্নীতির সুযোগও কমে আসছে।” রাফাল বিমান নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গ তবে ঊহ্য কেন, প্রশ্ন বিরোধীদের। বিরোধীদের কথায়,, ইউপিএ জমানায় তদন্তকারী সংস্থার অতি-সক্রিয়তা নিয়ে সরব ছিল বিজেপিই। ২০১৩ সালে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অপব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। লিখেছিলেন, ‘বিরোধীদের পিছনে তদন্তকারী সংস্থাকে অপব্যবহার করার প্রবণতা যদি রোখা না যায়, তা হলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।’ তৃণমূল নেতা সুখেন্দুশেখর রায়ের কথায়, ‘‘মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখে সেদিন বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি বলেছিলেন, সোহরাবউদ্দিন হত্যা মামলা-সহ নানা অভিযোগ এনে ইউপিএ সরকার নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ ও অন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছে। আর মোদীর আট বছরের রাজত্বে সব বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিজেপি কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে লেলিয়ে দিয়েছে। যেন বিরোধী মাত্রই দুর্নীতিপরায়ণ, আর ওরা সব ঈশ্বরের সন্তান!”