ফাঁকা টানেলে হাত নাড়ছেন প্রধানমন্ত্রী। শনিবার। পিটিআই
সকলের চোখ হাথরসে। আর তিনি হিমাচলে। অটল সুড়ঙ্গের গভীরে খোলা জিপে অটল ভাবে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কাকে?
গোটা সুড়ঙ্গ জনমানব শূন্য। বহু আগেই তা খালি করে দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে। সুড়ঙ্গ দিয়ে তখন ধীর গতিতে এগোচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কনভয়। ৯ কিলোমিটার সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রধানমন্ত্রীর যাত্রা ধরে রাখার জন্য স্থানে-স্থানে রাখা ছিল দূরদর্শনের ক্যামেরা। মুখে ফেসশিল্ড, মাথায় হিমাচলি টুপি পরে হাসি মুখে খালি সুড়ঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অবিরত হাত নেড়ে চলার লক্ষ্য ছিল ওই ক্যামেরাগুলিই!
হাথরসে তখন মেয়ের মৃত্যুর প্রকৃত বিচারের দাবিতে অনড় পরিবারকে রাজনৈতিক দল তো দূরের কথা, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দেখা করাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ। সুড়ঙ্গের এ প্রান্ত সিসুতে এক প্রস্ত বক্তব্য, তার পর সুড়ঙ্গ ভ্রমণ শেষে সোলান প্রান্তে ফের এক প্রস্ত বক্তব্য যখন প্রধানমন্ত্রী শেষ করলেন, তখন আড়াইটে বেজে গিয়েছে। যার কিছু ক্ষণ পরেই হাথরসের নির্যাতিতার গ্রামে ঢোকার অনুমতি পায় সংবাদমাধ্যম। প্রাক্তন পুলিশ কর্তারা অনেকেই বলছেন, হাথরাসের ঘটনা জুড়ে যে জনরোষ দেখা যাচ্ছে, তা আট বছর আগের নির্ভয়া আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রে এখন ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। নির্ভয়া কাণ্ডের সময়ে কেন্দ্রে ও দিল্লিতে উভয় স্থানেই কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যাওয়া নির্ভয়ার দেহ আনতে পালম বিমানন্দরে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। দায় এড়াননি। অথচ, এ ক্ষেত্রে ঘটনার বিরোধিতা করে একটি শব্দও বলতে শোনা যায়নি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের কোনও শীর্ষ নেতাকেই।
আরও পড়ুন: প্রিয়ঙ্কার রণে ‘দাদির তেজ’, পোশাকে টান দিল ‘বীরপুরুষ’
গত ক’দিনের মতো আজও দু’টি জনসভায় হাথরস নিয়ে নীরব ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের এক নেতার অভিযোগ, ‘‘ঘটনার পরে এক বার যোগীর সঙ্গে কথা বলেই দায়িত্ব সেরে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ গোড়া তিনি এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুললে ধামাচাপা দেওয়ার সাহস হত না উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নীরবতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এই সরকার কতটা অসংবেদনশীল।’’
আরও পড়ুন: হাথরসে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেন রাহুল-প্রিয়ঙ্কা
হাথরস প্রশ্নে জনরোষ ও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব পথে নামায় শাসক শিবির যে অস্বস্তিতে তা ঘরোয়া ভাবে মেনে নিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। মূলত রাহুল-প্রিয়ঙ্কা পথে নামায় বেশ কিছুটা ব্যাকফুটেই বিজেপি। তাই কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণ শানাতে আজ অটল সুড়ঙ্গের উদ্বোধনের মঞ্চকেই বেছে নেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সুড়ঙ্গের উদ্বোধন হওয়ার দেশের
মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে লাদাখের যোগাযোগ বাড়ল। তুষারপাতের সমস্যা এড়িয়ে যাতায়ত এখন সুগম হবে অনেকটাই। সীমান্তে রসদ পাঠানো থেকে সেনা মোতায়েন— সবই আগের চেয়ে অনেক অনায়াসে করা যাবে বলে আজ দাবি করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সীমান্ত পরিকাঠামোর প্রশ্নে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সুড়ঙ্গ কী ভাবে কংগ্রেসের আমলে দীর্ঘসূত্রী মনোভাবের শিকার হয়েছে, তা নিয়ে সরব হন মোদী। তিনি বলেন, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের শেষ পর্যায়ে ওই প্রকল্পে কাজ শুরু হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে ইউপিএ ক্ষমতায় আসতেই প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। ইউপিএ-র দশ বছরে মাত্রা ১৩০০ মিটার
সুড়ঙ্গ নির্মাণ হয়েছিল।’’ মোদীর দাবি, ওই গতিতে কাজ চললে প্রকল্পটি ২০৪০ সালে শেষ হত। কিন্তু তাঁর সরকার এসে সীমান্ত পরিকাঠামো উন্নয়নে নজর দিয়েছে। আগের সরকার যেখানে বছরে গড়ে ৩০০ মিটার নির্মাণের কাজ করেছিল, সেখানে এনডিএ প্রতি বছর ১৪০০ মিটার নির্মাণ করে ছ’বছরে কাজ শেষ করেছে। মোদীর কথায়, ‘‘২৬ বছরের বাকি কাজ মাত্র ছ’বছরে শেষ করা হয়েছে।’’
সুড়ঙ্গ বৃত্তান্ত
হিমাচল প্রদেশের এই সুড়ঙ্গ সমুদ্রতল থেকে
১০ হাজার ফুট উচ্চতায়।
পিরপঞ্জাল পাহাড় কেটে বানানো এই অটল টানেলই এত উচ্চতায় বিশ্বের দীর্ঘতম সড়ক-সুড়ঙ্গ।
দৈর্ঘ্য ৯.২ কিলোমিটার। মানালি থেকে লাহুল-স্পিতি পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই সুড়ঙ্গের ব্যবহারে মানালি এবং লে-এর
মধ্যে দূরত্ব কমবে ৪৬ কিলোমিটার। সময়েও কমবে কমপক্ষে চার ঘণ্টা।
অশ্বক্ষুরাকৃতি এই টানেলে দু’টি লেন। দু’দিকেই ফুটপাত।
রাস্তার প্রস্থ আট মিটার। ওভারহেড ক্লিয়ারেন্স ৫.৫২৫ মিটার।
দৈনিক তিন হাজার ছোট চার চাকার গাড়ি
এবং দেড় হাজার ট্রাক ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিবেগে যাতায়াত করতে পারবে।
সুড়ঙ্গের ভিতর অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ প্রযুক্তি।
৫০ মিটার অন্তর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।
২৫০ মিটার অন্তর সিসিটিভি ক্যামেরা।
১০ বছরে তৈরি করেছে ‘বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন’।
এখানেই না থেমে অটল সুড়ঙ্গের মতো লাদাখের দৌলত বেগ ওল্ডি এয়ারস্ট্রিপের আধুনিকীকরণের কাজ, দেশীয় ভাবে তেজস বিমান তৈরির কাজ কেন ইউপিএ আমলে বন্ধ ছিল, এ সব নিয়েও আজ প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের নাম না-করে মোদীর অভিযোগ, আগের সরকারের আমলে ওই কাজগুলি হয় প্রায় বন্ধ ছিল, অথবা সেগুলি ভুলে যাওয়া হয়েছিল। এর পিছনে কোন বাধ্যবাধকতা বা কার চাপ ছিল— তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘অটল সুড়ঙ্গের মতোই দৌলত বেগ ওল্ডি এয়ারস্ট্রিপ পাঁচ দশক ধরে বন্ধ ছিল।’’ মোদীর দাবি, তাঁর সরকারের আমলে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার এক পাশে থাকা দৌলত বেগ এয়ারস্ট্রিপ ফের চালু হয়।
লাদাখে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের পিছনে ওই এয়ারস্ট্রিপ চালু করাও একটি বড় কারণ। যা চালু হওয়া নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে বেজিংয়ের। আজ সীমান্ত রাজ্যে দাঁড়িয়ে ইউপিএ সরকারের সীমান্ত পরিকাঠামো নিয়ে গা-ছাড়া মনোভাবের সমালোচনা করে মোদী বলেন, ‘‘আগের সরকারের কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। আমি অন্তত ডজনখানেক এ ধরনের প্রকল্পের কথা বলতে পারি, যেগুলি সীমান্ত পরিকাঠামোর প্রশ্নে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সেগুলি নিয়ে অবহেলা করা হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। কিন্তু অতীতে এই দেশ এমন সময়ের সাক্ষী থেকেছে, যখন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আপস করা হয়েছে।”